হাউজে কাউসার
রসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নিজের চোখে নিজের জীবদ্দশায় নিজের দাওয়াতকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে উঠতে দেখেছেন এবং তাঁর হাতে এমন জামায়াত তৈরি হয়েছে যারা সারা দুনিয়ার ওপর ছেড়ে যাবার ক্ষতা রাখতো , এ নিয়ামতটিও এর অন্তরভুক্ত। ছেলে সন্তান থেকে বঞ্চিত হবার পর শত্রুরা মনে করতো তাঁর নাম - নিশানা দুনিয়া থেকে মিটে যাবে। কিন্তু আল্লাহ শুধু মুসলমানদের আকারে তাঁকে এমন ধরনের আধ্যাত্মিক সন্তান দিয়েই ক্ষান্ত হননি যারা কিয়ামত পর্যন্ত সারা দুনিয়ায় তাঁর নাম বুলন্দ করতে থাকবে বরং তাঁকে শুধুমাত্র একটি কন্যা হযরত ফাতেমার মাধ্যমে এত বিপুল পরিমাণ রক্তমাংসের সন্তান দান করেছেন যারা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে এবং মহান নবীর সাথে সম্পর্কই যাদের সবচেয়ে বড় অহংকার। এটিও এ নিয়মাতের অন্তরভুক্ত।
নিয়ামতগুলো আল্লাহ তাঁর নবীকে এ মরজগতেই দান করেছেন। কত বিপুল পরিমাণে দান করেছেন তা লোকেরা দেখেছে। এগুলো ছাড়াও কাউসার বলতে আরো দু'টো মহান ও বিশাল নিয়ামত বুঝানো হয়েছে , যা আল্লাহ তাঁকে আখেরাতে দান করবেন। সেগুলো সম্পর্কে জানার কোন মাধ্যম আমাদের কাছে ছিল না। তাই রসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সেগুলো সম্পর্কে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন : কাউসার বলতে দু'টি জিনিস বুঝানো হয়েছে। একটি হচ্ছে " হাউজে কাউসার " এটি কিয়ামতের ময়দানে তাঁকে দান করা হবে। আর দ্বিতীয়টি " কাউসার ঝরণাধারা। " এটি জান্নাতে তাঁকে দান করা হবে। এ দু'টির ব্যাপারে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এত বেশী হাদীস বর্ণিত হয়েছে এবং এত বিপুল সংখ্যক রাবী এ হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন যার ফলে এগুলোর নির্ভুল হবার ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহের ও অবকাশ নেই।
হাউজে কাউসার সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিম্নরূপ তথ্য পরিবেশন করেছেন :
এক : এ হাউজটি কিয়ামতের দিন তাঁকে দেয়া হবে। এমন এক কঠিন সময়ে এটি তাঁকে দেয়া হবে যখন সবাই " আল আতশ " ' আল আতশ ' অর্থাৎ পিপাসা , পিপাসা বলে চিৎকার করতে থাকবে সে সময় তাঁর উম্মত তাঁর কাছে এ হাউজের চারদিকে সমবেত হবে এবং এর পানি পান করবে। তিনি সবার আগে সেখানে পৌঁছবেন এবং তার মাঝ বরাবর জায়গায় বসে থাকবেন। তাঁর উক্তি :
"সেটি একটি হাউজ । আমার উম্মাত কিয়ামতের দিন তার কাছে থাকবে । " ( মুসলিম , কিতাবুস সারাত এবং আবু দাউদ , কিতাবুস সুন্নাহ )
" আমি তোমাদের সবার আগে সেখানে পৌঁছে যাবো। " ( বুখারী , কিতাবুর রিকাক ও কিতাবুল ফিতান , মুসলিম , কিতাবুল ফাযায়েল ও কিতাবুল তাহারাত , ইবনে মাজাহ , কিতাবুল মানাসিক ও কিতাবুয যুহদ এবং মুসনাদে আহমাদ , আবুদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা), আবুদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) ও আবু হুরাইরা (রা) বর্ণিত রেওয়ায়াতসমূহ)।
" আমি তোমাদের আগে পৌঁছে যাবো , তোমাদের জন্য সাক্ষ দেবো এবং আল্লাহর কসম , আমি এ মুহূর্তে আমার হাউজ দেখতে পাচ্ছি। ( বুখারী , কিতাবুল জানায়েয , কিতাবুল মাগাযী ও কিতাবুর রিকাক)।
আনসারদেরকে সম্বোধন করে একবার তিনি বলেন : " আমার পরে তোমরা স্বার্থবাদিতা ও স্বজনপ্রীতির পাল্লায় পড়বে। তখন তার ওপর সবর করবে , আমার সাথে হাউজে কাউসারে এসে মিলিত হওয়া পর্যন্ত । " ( বুখারী , কিতাবু মানাকিবিল আনসার ও কিতাবুল মাগাযী , মুসলিম , কিতাবুল আমারাহ এবং তিরমিযী কিতাবুল ফিতান।)
" কিয়ামতের দিন হাউজের মাঝ বরাবর থাকবো। " ( মুসলিম কিতাবুল ফাজায়েল ) হযরত আবু বারযাহ আসলামীকে (রা) জিজ্ঞেস করা হলো , আপনি কি হাউজ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কিছু শুনেছেন। তিনি বলেন , " একবার নয় , দু'বার নয় , তিনবার নয় , চারবার নয় , পাঁচবার নয় , বারবার শুনেছি । যে ব্যক্তি একে মিথ্যা বলবে আল্লাহ তাকে যেন তার পানি পান না করান । " (আবু দাউদ , কিতাবুস সুন্নাহ )। উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ হাউজ সম্পর্কিত রেওয়ায়াত মিথ্যা মনে করতো। এমন কি সে হযরত আবু বারযাহ আসলামী (রা), বারাআ ইবনে আযেব (রা) ও আয়েদ ইবনে আমর (রা) বর্ণিত রেওয়ায়াতগুলো অস্বীকার করলো। শেষে আবু সাবরাহ একটি লিপি বের করে আনলেন। এ লিপিটি তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আসের (রা) মুখে শুনে লিখে রেখেছিলেন । তাতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বাণী লেখা ছিল : " জেনে রাখো , আমার ও তোমাদের সাক্ষাতের স্থান হচ্ছে আমার হাউজ। " ( মুসনাদে আহমাদ , আবদুল্লাহ ইবনে আমার ইবনুল আসের রেওয়ায়াতসমূহ )।
দুই : এ হাউজের আয়তন সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীসে বিভিন্ন প্রকার বর্ণনা এসেছে। তবে অধিকাংশ রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে : এটি আইলা ( ইসরাঈলের বর্তমান বন্দর আইলাত ) থেকে ইয়ামনের সান 'আ পর্যন্ত অথবা আইল থেকে এডন পর্যন্ত কিংবা আম্মান থেকে এডেন পর্যন্ত দীর্ঘ হবে। আর এটি চওড়া হবে আইলা থেকে হুজকাহ ( জেদ্দা ও রাবেগের মাঝখানে একটি স্থান ) পর্যন্ত জায়গায় সমপরিমাণ । বুখারী , কিতাবুর রিকাক , আবু দাউদ তায়ালাসী ৯৯৫ হাদীস , মুসনাদে আহমাদ , আবু বকর সিদ্দীক ও আবুদল্লাহ ইবনে ওপর বর্ণিত রেওয়ায়াতসমূহ , মুসলিম - কিতাবুত তাহারাত ও কিতাবুল ফাজায়েল , তিরমিযি ---- আবওয়াবু সিফাতিল কিয়ামহ এবং ইবনে মাজাহ - কিতাবুয যুহুদ ।) এ থেকে অনুমান করা যায় , বর্তমান লোহিত সাগরটিকেই কিয়ামতের দিন হাউজে কাউসারে পরিবর্তিত করে দেয়া হবে। তবে আসল ব্যাপার একমাত্র আল্লাহই ভালো জানে।
তিন : এ হাউজটি সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন , জান্নাতের কাউসার ঝরণাধারা (সামনে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ) থেকে পানি এনে এতে ঢালা হবে। একটি হাদীসে বলা হয়েছে : জান্নাতে থেকে দু'টি খাল কেটে এনে তাতে ফেলা হবে এবং এর সাহায্যে থেকে তাতে পানি সরবরাহ হবে। (মুসলিম কিতাবুল ফাজায়েল ) অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে : জান্নাতের কাওসার ঝরণাধারা থেকে একটি নহর এ হাউজের দিকে খুলে দেয়া হবে এবং তার সাহায্যে এতে পানি সরবরাহ জারী থাকবে ( মুসনাদে আহমাদ , আবুদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বর্ণিত রেওয়ায়াতসমূহ )
চার : হাউজে কাউসারের অবস্থা সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বরেছেন যে , তার পানি হবে দুধের চাইতে ( কোন কোন রেওয়ায়াত অনুযায়ী রূপার চাইতে আবার কোন কোন রেয়ায়াত অনুযায়ী বরফের চাইতে ) বেশী সাদা ,বরফের চাইতে বেশী ঠাণ্ডা এবং মধুর চাইতে বেশী মিষ্টি। তার তলদেশের মাটি হবে মিশকের চাইতে বেশী সুগন্ধিযুক্ত। আকাশে যত তারা আছে ততটি সোরাহী তার পাশে রাখা থাকবে। তার পানি একবার পান করার পর দ্বিতীয়বার কারো পিপাসা লাগবে না। আর তার পানি যে একবার পান করেনি তার পিপাসা কোনদিন মিটবে না। সামান্য শাব্দিক হেরফেরসহ একথাগুলোই অসংখ্য হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে। (বুখারী কিতাবুর রিকাক , মুসলিম - কিতাবুত তাহারাত ও কিতাবুল ফাজায়েল , মুসনাদে আহমাদ - ইবনে মাসউদ ইবনে উমর ও আবদুল্লাহ উবনে আমর ইবনুল ' আস বর্ণিত রেওয়ায়াত সমূহ , তিরমিযী আবওয়াবু সিফাতিল কিয়ামহ , ইবনে মাজাহ কিতাবুয যুহোদ এবং আবু দাউদ আত তায়ালাসী , ৯৯৫ ও ২১৩৫ হাদীস।
পাঁচ : রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বরবার তাঁর সময়ের লোকদের সতর্ক করে দিয়ে বরেছেন , আমার পরে তোমাদের মধ্য থেকে যারাই আমার তরিকা পদ্ধতি পরিবর্তন করবে তাদেরকে এ হাউজের কাছ থেকে হটিয়ে দেয়া হবে এবং এর পানির কাছে তাদের আসতে দেয়া হবে না। আমি বলবো , এরা আমার লোক । জবাবে আমাকে বলা হবে , আপনি জানেন না আপনার পরে এরা কি করেছে। । তখন আমি ও তাদেরকে তাড়িয়ে দেবো। আমি বলবো , দূর হয়ে যাও। এ বক্তব্যটি অসংখ্য হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে। ( বুখারী - কিতাবুল ফিতান ও কিতাবুর রিকাক , মুসলিম কিতাবুত তাহারাত ও কিতাবুল ফাজায়েল , মুসনাদে আহমাদ - ইবনে মাসউদ ও আবু হুরাইরা বর্ণিত হাদীসমূহ , ইবনে মাজাহ -- কিতাবুল মানাসিক।) ইবনে মাজাহ এ ব্যাপারে যে হাদীস উদ্ধৃত করেছেন তার শব্দগুলো বড়ই হৃদয়স্পর্শী । তাতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
" সাবধান হয়ে যাও ! আমি তোমাদের আগে হাউজে উপস্থিত থাকবো । তোমাদের মাধ্যমে অন্য উম্মাতদের মোকাবিলায় আমি নিজের উম্মাতের বিপুল সংখ্যাক জন্য গর্ব করতে থাকবো। সে সময় আমার মুখে কালিমা লেপন করো না। সাবধান হয়ে যাও ! কিছু লোককে আমি ছাড়িয়ে নেবো আর কিছু লোককে আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয়া হবে।
আমি বলব হে আমার রব ! এরা তো আমার সাহাবী। তিনি বলবেন , তুমি জানো না তোমার পরে এরা কী অভিনব কাজ কারবার করেছে । " ইবনে মাজার বক্তব্য হচ্ছে , এ শব্দগুলো রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর আরাফাত ময়দানের ভাষণে বলেছিলেন ।
ছয় : এভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পর থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত সময় কালের সমগ্র মুসলিম মিল্লাতকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন : তোমাদের মধ্য থেকে যারাই আমার পথ থেকে সরে গিয়ে অন্য পথে চলবে এবং তার মধ্যে রদবদল করবে তাদেরকে এ হাউজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়া হবে। আমি বলবো : হে আমার রব ! এরা তো আমার উম্মাতের লোক। জবাবে বলা হবে : আপনি জানেন না , আপনার পরে এরা কি কি পরিবর্তন করেছিল এবং আপনার পথের উল্টোদিকে চলে গিয়েছিল। তখন আমি ও তাদেরকে দূর করে দেবো। এবং তাদেরকে হাউজের ধারে কাছে ঘেঁসতে দেবো না। হাদীস গ্রন্থগুলোতে এ বিষয়বস্তু সম্বলিত অসংখ্য হাদীস উল্লেখিত হয়েছে। ( বুখারী -- কিতাবুল মুসাকাত , কিতাবুর রিকাক ও কিতাবুল ফিতান , মুসলিম - কিতাবুত তাহারাত , কিতাবুস সালাত ও কিতাবুল ফাজায়েল , ইবনে মাজাহ - কিতাবুয যুহুদ , মুসনাদে আহামদ-আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীসসমূহ)।
পঞ্চাশ জনের ও বেশী সাহাবী এ হাউজ সংক্রান্ত হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন। প্রথম যুগের আলেমগণ সাধারণভাবে এটিকে হাউজে কাউসার বলেছেন । ইমাম বুখারী কিতাবুর রিকাকের শেষ অনুচ্ছেদের শিরোনাম রাখেন নিম্নোক্তভাবে : ( হাউজ অনুচ্ছেদ , আর আল্লাহ বলেছেন : আমি তোমাকে কাউসার দিয়েছি )। অন্য দিকে হযরত আনাসের রেওয়ায়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে , রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাউসার সম্পর্কে বলেছেন : " সেটি একটি হাউজ । আমার উম্মাত সেখানে উপস্থিত হবে। " জান্নাতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কাউসার নামে যে নহরটি দেয়া হবে সেটির উল্লেখ ও অসংখ্য হাদীসে পাওয়া যায়। হযরত আনাস (রা) থেকে এ সংক্রান্ত বহু হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। সেগুলোতে তিনি বলেন ( আবার কোন কোনটিতে তিনি স্পষ্টভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তি হিসেবেই বর্ণনা করেন ) : মি'রাজে রসূলুল্লাহকে ( সা) জান্নাতে সফর করানো হয়। এ সময় তিনি একটি নহর দেখেন। এ নহরের তীরদেশে ভিতর থেকে হীরা বা মুক্তার কারুকার্য করা গোলাকৃতির মেহরাবসমূহ ছিল্ ,তার তলদেশের মাটি ছিল খাঁটি মিশকের সুগন্ধিযুক্ত। রসূলুল্লাহ (সা) জিরীলকে বা যে ফেরেশতা তাঁকে ভ্রমণ করিয়েছিলেন তাঁকে জিজ্ঞেস করেন , এটা কি ৷ ফেরেশতা জাবাব দেন , এটা কাউসার নহর। আল্লাহ আপনাকে এ নহরটি দিয়েছেন। ( মুসনাদে আহামদ , বুখারী , তিরমিযী , আবু দাউদ তায়ালাসী ও ইবেন জারীর )। হযরত আনাস এক রেওয়ায়াতে বলেন , রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল , অথবা এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেন : কাউসার কি ৷ তিনি জবাব দিলেন : একটি নহর যা আল্লাহ আমাকে জান্নাতে দান করেছেন। এর মাটি মিশকের । এর পানি দুধের চাইতেও সাদা এবং মধুর চাইতে মিষ্টি। ( মুসনাদে আহমাদ , তিরমিযী , ইবনে জারীর )। মুসনাদে আহমাদের অন্য একটি রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে , রসূলুল্লাহ (সা) নহরে কাউসারের বৈশিষ্ট বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন : তার তলদেশে কাঁকরের পরিবর্তে মণিমুক্তা পড়ে আছে। ইবনে ওমর (রা) বলেন , রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : কাউসার জান্নাতের একটি নহর। এর তীরদেশ সোনার পরিবর্তে মূল্যবান পাথর বিছানো আছে। ) এর মাটি মিশকের চাইতে বেশী সুগন্ধিযুক্ত। পানি দুধের চাইতে বেশী সাদা। বরফের চেয়ে বেশী ঠাণ্ডা ও মধুর চেয়ে বেশী মিষ্টি। ( মুসনাদে আহামদ ,তিরমিযী , ইবনে মাজাহ , ইবনে আবী হাতেম , দারেমী , আবু দাউদ , ইবনুল মুনযির , ইবনে মারদুইয়া ও ইবনে আবী শাইবা )। উসামা ইবনে যায়েদ (রা) রেওয়ায়াত করেছেন , রসূলুল্লাহ (সা) একবার হযরত হামাযার (রা) বাড়িতে যান। তিনি বাড়িতে ছিলেন না । তাঁর স্ত্রী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেহেমানদারী করেন। আলাপ আলোচনা করতে করতে এক সময় তিনি বলেন , আমার স্বামী আমাকে বলেছেন , আপনাকে জান্নাতে একটি নহর দেয়া হবে। তার নাম কাউসার। তিনি বলেন : " হ্যাঁ , তার যমীন ইয়াকুত , মারজান , যবরযদ ও মতির সমন্বেয় গঠিত। ( ইবনে জারীর ও ইবন মারদুইয়া । এ হাদীসটির সূত্র দুর্বল হলেও এ বিষয়বস্তু সম্বলিত বিপুল সংখ্যক হাদীস পাওয়া যাওয়ার কারণ এর শক্তি বেড়ে গেছে )। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উক্তি এবং সাহাবা ও তাবেঈগণের অসংখ্য বক্তব্য হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে। এ সবগুলোতে কাউসার বলতে জান্নাতের এ নহরই বুঝানো হযেছে। ওপরে এ নহরের যে সব বৈশিষ্ট বর্ণিত হয়েছে এ হাদীসগুলোতেই তাই বলা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) , হযরত আবুদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) , হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) , হযরত আয়েশা (রা) , মুজাহিদ ও আবুল আলীয়ার উক্তিসমূহ মুসনাদে আহমাদ , বুখারী , তিরমিযী , নাসাঈ , ইবনে মারদুইয়া , ইবনে জারীর ও ইবনে আবী শাইবা ইত্যাদি মুহাদ্দিসগনের কিতাবে উল্লেখিত হয়েছে।
রসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নিজের চোখে নিজের জীবদ্দশায় নিজের দাওয়াতকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে উঠতে দেখেছেন এবং তাঁর হাতে এমন জামায়াত তৈরি হয়েছে যারা সারা দুনিয়ার ওপর ছেড়ে যাবার ক্ষতা রাখতো , এ নিয়ামতটিও এর অন্তরভুক্ত। ছেলে সন্তান থেকে বঞ্চিত হবার পর শত্রুরা মনে করতো তাঁর নাম - নিশানা দুনিয়া থেকে মিটে যাবে। কিন্তু আল্লাহ শুধু মুসলমানদের আকারে তাঁকে এমন ধরনের আধ্যাত্মিক সন্তান দিয়েই ক্ষান্ত হননি যারা কিয়ামত পর্যন্ত সারা দুনিয়ায় তাঁর নাম বুলন্দ করতে থাকবে বরং তাঁকে শুধুমাত্র একটি কন্যা হযরত ফাতেমার মাধ্যমে এত বিপুল পরিমাণ রক্তমাংসের সন্তান দান করেছেন যারা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে এবং মহান নবীর সাথে সম্পর্কই যাদের সবচেয়ে বড় অহংকার। এটিও এ নিয়মাতের অন্তরভুক্ত।
নিয়ামতগুলো আল্লাহ তাঁর নবীকে এ মরজগতেই দান করেছেন। কত বিপুল পরিমাণে দান করেছেন তা লোকেরা দেখেছে। এগুলো ছাড়াও কাউসার বলতে আরো দু'টো মহান ও বিশাল নিয়ামত বুঝানো হয়েছে , যা আল্লাহ তাঁকে আখেরাতে দান করবেন। সেগুলো সম্পর্কে জানার কোন মাধ্যম আমাদের কাছে ছিল না। তাই রসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সেগুলো সম্পর্কে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন : কাউসার বলতে দু'টি জিনিস বুঝানো হয়েছে। একটি হচ্ছে " হাউজে কাউসার " এটি কিয়ামতের ময়দানে তাঁকে দান করা হবে। আর দ্বিতীয়টি " কাউসার ঝরণাধারা। " এটি জান্নাতে তাঁকে দান করা হবে। এ দু'টির ব্যাপারে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এত বেশী হাদীস বর্ণিত হয়েছে এবং এত বিপুল সংখ্যক রাবী এ হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন যার ফলে এগুলোর নির্ভুল হবার ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহের ও অবকাশ নেই।
হাউজে কাউসার সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিম্নরূপ তথ্য পরিবেশন করেছেন :
এক : এ হাউজটি কিয়ামতের দিন তাঁকে দেয়া হবে। এমন এক কঠিন সময়ে এটি তাঁকে দেয়া হবে যখন সবাই " আল আতশ " ' আল আতশ ' অর্থাৎ পিপাসা , পিপাসা বলে চিৎকার করতে থাকবে সে সময় তাঁর উম্মত তাঁর কাছে এ হাউজের চারদিকে সমবেত হবে এবং এর পানি পান করবে। তিনি সবার আগে সেখানে পৌঁছবেন এবং তার মাঝ বরাবর জায়গায় বসে থাকবেন। তাঁর উক্তি :
"সেটি একটি হাউজ । আমার উম্মাত কিয়ামতের দিন তার কাছে থাকবে । " ( মুসলিম , কিতাবুস সারাত এবং আবু দাউদ , কিতাবুস সুন্নাহ )
" আমি তোমাদের সবার আগে সেখানে পৌঁছে যাবো। " ( বুখারী , কিতাবুর রিকাক ও কিতাবুল ফিতান , মুসলিম , কিতাবুল ফাযায়েল ও কিতাবুল তাহারাত , ইবনে মাজাহ , কিতাবুল মানাসিক ও কিতাবুয যুহদ এবং মুসনাদে আহমাদ , আবুদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা), আবুদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) ও আবু হুরাইরা (রা) বর্ণিত রেওয়ায়াতসমূহ)।
" আমি তোমাদের আগে পৌঁছে যাবো , তোমাদের জন্য সাক্ষ দেবো এবং আল্লাহর কসম , আমি এ মুহূর্তে আমার হাউজ দেখতে পাচ্ছি। ( বুখারী , কিতাবুল জানায়েয , কিতাবুল মাগাযী ও কিতাবুর রিকাক)।
আনসারদেরকে সম্বোধন করে একবার তিনি বলেন : " আমার পরে তোমরা স্বার্থবাদিতা ও স্বজনপ্রীতির পাল্লায় পড়বে। তখন তার ওপর সবর করবে , আমার সাথে হাউজে কাউসারে এসে মিলিত হওয়া পর্যন্ত । " ( বুখারী , কিতাবু মানাকিবিল আনসার ও কিতাবুল মাগাযী , মুসলিম , কিতাবুল আমারাহ এবং তিরমিযী কিতাবুল ফিতান।)
" কিয়ামতের দিন হাউজের মাঝ বরাবর থাকবো। " ( মুসলিম কিতাবুল ফাজায়েল ) হযরত আবু বারযাহ আসলামীকে (রা) জিজ্ঞেস করা হলো , আপনি কি হাউজ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কিছু শুনেছেন। তিনি বলেন , " একবার নয় , দু'বার নয় , তিনবার নয় , চারবার নয় , পাঁচবার নয় , বারবার শুনেছি । যে ব্যক্তি একে মিথ্যা বলবে আল্লাহ তাকে যেন তার পানি পান না করান । " (আবু দাউদ , কিতাবুস সুন্নাহ )। উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ হাউজ সম্পর্কিত রেওয়ায়াত মিথ্যা মনে করতো। এমন কি সে হযরত আবু বারযাহ আসলামী (রা), বারাআ ইবনে আযেব (রা) ও আয়েদ ইবনে আমর (রা) বর্ণিত রেওয়ায়াতগুলো অস্বীকার করলো। শেষে আবু সাবরাহ একটি লিপি বের করে আনলেন। এ লিপিটি তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আসের (রা) মুখে শুনে লিখে রেখেছিলেন । তাতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বাণী লেখা ছিল : " জেনে রাখো , আমার ও তোমাদের সাক্ষাতের স্থান হচ্ছে আমার হাউজ। " ( মুসনাদে আহমাদ , আবদুল্লাহ ইবনে আমার ইবনুল আসের রেওয়ায়াতসমূহ )।
দুই : এ হাউজের আয়তন সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীসে বিভিন্ন প্রকার বর্ণনা এসেছে। তবে অধিকাংশ রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে : এটি আইলা ( ইসরাঈলের বর্তমান বন্দর আইলাত ) থেকে ইয়ামনের সান 'আ পর্যন্ত অথবা আইল থেকে এডন পর্যন্ত কিংবা আম্মান থেকে এডেন পর্যন্ত দীর্ঘ হবে। আর এটি চওড়া হবে আইলা থেকে হুজকাহ ( জেদ্দা ও রাবেগের মাঝখানে একটি স্থান ) পর্যন্ত জায়গায় সমপরিমাণ । বুখারী , কিতাবুর রিকাক , আবু দাউদ তায়ালাসী ৯৯৫ হাদীস , মুসনাদে আহমাদ , আবু বকর সিদ্দীক ও আবুদল্লাহ ইবনে ওপর বর্ণিত রেওয়ায়াতসমূহ , মুসলিম - কিতাবুত তাহারাত ও কিতাবুল ফাজায়েল , তিরমিযি ---- আবওয়াবু সিফাতিল কিয়ামহ এবং ইবনে মাজাহ - কিতাবুয যুহুদ ।) এ থেকে অনুমান করা যায় , বর্তমান লোহিত সাগরটিকেই কিয়ামতের দিন হাউজে কাউসারে পরিবর্তিত করে দেয়া হবে। তবে আসল ব্যাপার একমাত্র আল্লাহই ভালো জানে।
তিন : এ হাউজটি সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন , জান্নাতের কাউসার ঝরণাধারা (সামনে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ) থেকে পানি এনে এতে ঢালা হবে। একটি হাদীসে বলা হয়েছে : জান্নাতে থেকে দু'টি খাল কেটে এনে তাতে ফেলা হবে এবং এর সাহায্যে থেকে তাতে পানি সরবরাহ হবে। (মুসলিম কিতাবুল ফাজায়েল ) অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে : জান্নাতের কাওসার ঝরণাধারা থেকে একটি নহর এ হাউজের দিকে খুলে দেয়া হবে এবং তার সাহায্যে এতে পানি সরবরাহ জারী থাকবে ( মুসনাদে আহমাদ , আবুদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বর্ণিত রেওয়ায়াতসমূহ )
চার : হাউজে কাউসারের অবস্থা সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বরেছেন যে , তার পানি হবে দুধের চাইতে ( কোন কোন রেওয়ায়াত অনুযায়ী রূপার চাইতে আবার কোন কোন রেয়ায়াত অনুযায়ী বরফের চাইতে ) বেশী সাদা ,বরফের চাইতে বেশী ঠাণ্ডা এবং মধুর চাইতে বেশী মিষ্টি। তার তলদেশের মাটি হবে মিশকের চাইতে বেশী সুগন্ধিযুক্ত। আকাশে যত তারা আছে ততটি সোরাহী তার পাশে রাখা থাকবে। তার পানি একবার পান করার পর দ্বিতীয়বার কারো পিপাসা লাগবে না। আর তার পানি যে একবার পান করেনি তার পিপাসা কোনদিন মিটবে না। সামান্য শাব্দিক হেরফেরসহ একথাগুলোই অসংখ্য হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে। (বুখারী কিতাবুর রিকাক , মুসলিম - কিতাবুত তাহারাত ও কিতাবুল ফাজায়েল , মুসনাদে আহমাদ - ইবনে মাসউদ ইবনে উমর ও আবদুল্লাহ উবনে আমর ইবনুল ' আস বর্ণিত রেওয়ায়াত সমূহ , তিরমিযী আবওয়াবু সিফাতিল কিয়ামহ , ইবনে মাজাহ কিতাবুয যুহোদ এবং আবু দাউদ আত তায়ালাসী , ৯৯৫ ও ২১৩৫ হাদীস।
পাঁচ : রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বরবার তাঁর সময়ের লোকদের সতর্ক করে দিয়ে বরেছেন , আমার পরে তোমাদের মধ্য থেকে যারাই আমার তরিকা পদ্ধতি পরিবর্তন করবে তাদেরকে এ হাউজের কাছ থেকে হটিয়ে দেয়া হবে এবং এর পানির কাছে তাদের আসতে দেয়া হবে না। আমি বলবো , এরা আমার লোক । জবাবে আমাকে বলা হবে , আপনি জানেন না আপনার পরে এরা কি করেছে। । তখন আমি ও তাদেরকে তাড়িয়ে দেবো। আমি বলবো , দূর হয়ে যাও। এ বক্তব্যটি অসংখ্য হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে। ( বুখারী - কিতাবুল ফিতান ও কিতাবুর রিকাক , মুসলিম কিতাবুত তাহারাত ও কিতাবুল ফাজায়েল , মুসনাদে আহমাদ - ইবনে মাসউদ ও আবু হুরাইরা বর্ণিত হাদীসমূহ , ইবনে মাজাহ -- কিতাবুল মানাসিক।) ইবনে মাজাহ এ ব্যাপারে যে হাদীস উদ্ধৃত করেছেন তার শব্দগুলো বড়ই হৃদয়স্পর্শী । তাতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
" সাবধান হয়ে যাও ! আমি তোমাদের আগে হাউজে উপস্থিত থাকবো । তোমাদের মাধ্যমে অন্য উম্মাতদের মোকাবিলায় আমি নিজের উম্মাতের বিপুল সংখ্যাক জন্য গর্ব করতে থাকবো। সে সময় আমার মুখে কালিমা লেপন করো না। সাবধান হয়ে যাও ! কিছু লোককে আমি ছাড়িয়ে নেবো আর কিছু লোককে আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয়া হবে।
আমি বলব হে আমার রব ! এরা তো আমার সাহাবী। তিনি বলবেন , তুমি জানো না তোমার পরে এরা কী অভিনব কাজ কারবার করেছে । " ইবনে মাজার বক্তব্য হচ্ছে , এ শব্দগুলো রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর আরাফাত ময়দানের ভাষণে বলেছিলেন ।
ছয় : এভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পর থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত সময় কালের সমগ্র মুসলিম মিল্লাতকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন : তোমাদের মধ্য থেকে যারাই আমার পথ থেকে সরে গিয়ে অন্য পথে চলবে এবং তার মধ্যে রদবদল করবে তাদেরকে এ হাউজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়া হবে। আমি বলবো : হে আমার রব ! এরা তো আমার উম্মাতের লোক। জবাবে বলা হবে : আপনি জানেন না , আপনার পরে এরা কি কি পরিবর্তন করেছিল এবং আপনার পথের উল্টোদিকে চলে গিয়েছিল। তখন আমি ও তাদেরকে দূর করে দেবো। এবং তাদেরকে হাউজের ধারে কাছে ঘেঁসতে দেবো না। হাদীস গ্রন্থগুলোতে এ বিষয়বস্তু সম্বলিত অসংখ্য হাদীস উল্লেখিত হয়েছে। ( বুখারী -- কিতাবুল মুসাকাত , কিতাবুর রিকাক ও কিতাবুল ফিতান , মুসলিম - কিতাবুত তাহারাত , কিতাবুস সালাত ও কিতাবুল ফাজায়েল , ইবনে মাজাহ - কিতাবুয যুহুদ , মুসনাদে আহামদ-আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীসসমূহ)।
পঞ্চাশ জনের ও বেশী সাহাবী এ হাউজ সংক্রান্ত হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন। প্রথম যুগের আলেমগণ সাধারণভাবে এটিকে হাউজে কাউসার বলেছেন । ইমাম বুখারী কিতাবুর রিকাকের শেষ অনুচ্ছেদের শিরোনাম রাখেন নিম্নোক্তভাবে : ( হাউজ অনুচ্ছেদ , আর আল্লাহ বলেছেন : আমি তোমাকে কাউসার দিয়েছি )। অন্য দিকে হযরত আনাসের রেওয়ায়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে , রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাউসার সম্পর্কে বলেছেন : " সেটি একটি হাউজ । আমার উম্মাত সেখানে উপস্থিত হবে। " জান্নাতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কাউসার নামে যে নহরটি দেয়া হবে সেটির উল্লেখ ও অসংখ্য হাদীসে পাওয়া যায়। হযরত আনাস (রা) থেকে এ সংক্রান্ত বহু হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। সেগুলোতে তিনি বলেন ( আবার কোন কোনটিতে তিনি স্পষ্টভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তি হিসেবেই বর্ণনা করেন ) : মি'রাজে রসূলুল্লাহকে ( সা) জান্নাতে সফর করানো হয়। এ সময় তিনি একটি নহর দেখেন। এ নহরের তীরদেশে ভিতর থেকে হীরা বা মুক্তার কারুকার্য করা গোলাকৃতির মেহরাবসমূহ ছিল্ ,তার তলদেশের মাটি ছিল খাঁটি মিশকের সুগন্ধিযুক্ত। রসূলুল্লাহ (সা) জিরীলকে বা যে ফেরেশতা তাঁকে ভ্রমণ করিয়েছিলেন তাঁকে জিজ্ঞেস করেন , এটা কি ৷ ফেরেশতা জাবাব দেন , এটা কাউসার নহর। আল্লাহ আপনাকে এ নহরটি দিয়েছেন। ( মুসনাদে আহামদ , বুখারী , তিরমিযী , আবু দাউদ তায়ালাসী ও ইবেন জারীর )। হযরত আনাস এক রেওয়ায়াতে বলেন , রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল , অথবা এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেন : কাউসার কি ৷ তিনি জবাব দিলেন : একটি নহর যা আল্লাহ আমাকে জান্নাতে দান করেছেন। এর মাটি মিশকের । এর পানি দুধের চাইতেও সাদা এবং মধুর চাইতে মিষ্টি। ( মুসনাদে আহমাদ , তিরমিযী , ইবনে জারীর )। মুসনাদে আহমাদের অন্য একটি রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে , রসূলুল্লাহ (সা) নহরে কাউসারের বৈশিষ্ট বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন : তার তলদেশে কাঁকরের পরিবর্তে মণিমুক্তা পড়ে আছে। ইবনে ওমর (রা) বলেন , রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : কাউসার জান্নাতের একটি নহর। এর তীরদেশ সোনার পরিবর্তে মূল্যবান পাথর বিছানো আছে। ) এর মাটি মিশকের চাইতে বেশী সুগন্ধিযুক্ত। পানি দুধের চাইতে বেশী সাদা। বরফের চেয়ে বেশী ঠাণ্ডা ও মধুর চেয়ে বেশী মিষ্টি। ( মুসনাদে আহামদ ,তিরমিযী , ইবনে মাজাহ , ইবনে আবী হাতেম , দারেমী , আবু দাউদ , ইবনুল মুনযির , ইবনে মারদুইয়া ও ইবনে আবী শাইবা )। উসামা ইবনে যায়েদ (রা) রেওয়ায়াত করেছেন , রসূলুল্লাহ (সা) একবার হযরত হামাযার (রা) বাড়িতে যান। তিনি বাড়িতে ছিলেন না । তাঁর স্ত্রী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেহেমানদারী করেন। আলাপ আলোচনা করতে করতে এক সময় তিনি বলেন , আমার স্বামী আমাকে বলেছেন , আপনাকে জান্নাতে একটি নহর দেয়া হবে। তার নাম কাউসার। তিনি বলেন : " হ্যাঁ , তার যমীন ইয়াকুত , মারজান , যবরযদ ও মতির সমন্বেয় গঠিত। ( ইবনে জারীর ও ইবন মারদুইয়া । এ হাদীসটির সূত্র দুর্বল হলেও এ বিষয়বস্তু সম্বলিত বিপুল সংখ্যক হাদীস পাওয়া যাওয়ার কারণ এর শক্তি বেড়ে গেছে )। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উক্তি এবং সাহাবা ও তাবেঈগণের অসংখ্য বক্তব্য হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে। এ সবগুলোতে কাউসার বলতে জান্নাতের এ নহরই বুঝানো হযেছে। ওপরে এ নহরের যে সব বৈশিষ্ট বর্ণিত হয়েছে এ হাদীসগুলোতেই তাই বলা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) , হযরত আবুদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) , হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) , হযরত আয়েশা (রা) , মুজাহিদ ও আবুল আলীয়ার উক্তিসমূহ মুসনাদে আহমাদ , বুখারী , তিরমিযী , নাসাঈ , ইবনে মারদুইয়া , ইবনে জারীর ও ইবনে আবী শাইবা ইত্যাদি মুহাদ্দিসগনের কিতাবে উল্লেখিত হয়েছে।