জন্ম নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের পটভূমি :
জন্ম নিয়ন্ত্রণ (Birth control) আন্দোলন আঠারো শতকের শেষাংশে ইউরোপে সূচনা হয়। সম্ভবত: ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসই (Malthus) এর ভিত্তি রচনা করেন। এ আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্য হ’ল বংশ বৃদ্ধি প্রতিরোধ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার দেখে মি. ম্যালথাস হিসাব করেন, পৃথিবীতে আবাদযোগ্য জমি ও অর্থনৈতিক উপায়-উপাদান সীমিত। কিন্তু বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনা সীমাহীন। ১৭৯৮ সালে মি. ম্যালথাস রচিত An essay on population and as it effects, the future improvment of the society. (জনসংখ্যা ও সমাজের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে এর প্রভাব) নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম তার মতবাদ প্রচার করেন। এরপর ফ্র্যান্সিস প্ল্যাস (Francis Place) ফরাসী দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধ করার প্রতি জোর প্রচারণা চালান। কিন্তু তিনি নৈতিক উপায় বাদ দিয়ে ঔষধ ও যন্ত্রাদির সাহায্যে গর্ভনিরোধ করার প্রস্তাব দেন। আমেরিকার বিখ্যাত ডাক্তার চার্লস নোল্টন (Charles knowlton) ১৮৩৩ সালে এ প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন সূচক উক্তি করেন। তিনি তার রচিত The Fruits of philosophy নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম গর্ভনিরোধের চিকিৎসা শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা এবং এর উপকারের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
কিন্তু মাঝখানে ১৮৪০ সাল থেকে ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত এ আন্দোলন বন্ধ থাকে। ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা এর প্রতি কোনরূপ গুরুত্বারোপ ও সহযোগিতা করতে অস্বীকার জানিয়েছিলেন।
আবার ১৮৭৬ সালে নতুন করে ম্যালথাসীয় আন্দোলন (New Malthusian Movment) নামক নতুন আন্দোলন শুরু হয়। মিসেস এ্যানী বাসন্ত ও চার্লস ব্রাডার ডাঃ নোল্টনের (Fruits of philosophy) গ্রন্থটি ১৮৭৬ সালে ইংল্যান্ডে প্রকাশ করেন। ১৯৭৭ সালে ডাঃ ড্রাইসডেল (Drysdale)-এর সভাপতিত্বে একটি সমিতি গঠিত হয় ও জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রচার কার্য শুরু হয়ে যায়।
১৮৭৯ সালে মিসেস বাসন্ত-এর রচিত Law of population (জনসংখ্যার আইন) নামক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৮৮১ সালে হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও জার্মানীতে এ আন্দোলন ছড়িয়ে যায় এবং ক্রমে ইউরোপ ও আমেরিকার সকল সভ্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্থানে স্থানে জন্মনিরোধ ক্লিনিক (Birth Control Clinics) খুলে দেয়। [1]
বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীতে সারা বিশ্বে জন্মনিয়ন্ত্রণের নামে প্রকাশ্যে সন্তান হত্যার হিড়িক পড়ে গেছে। এমনকি দৈনিক পত্রিকাসহ সকল মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচারণা চলছে। যেমন ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দু’টি সন্তানই যথেষ্ট’, দুইটি সন্তানের বেশী নয়, একটি হ’লে ভালো হয়’ ইত্যাদি। এছাড়াও কিছু স্যাটেলাইট ক্লিনিক গর্ভবর্তী মায়ের সেবার নামে গর্ভপাত ঘটানোর গ্যারেজে পরিণত হয়েছে।
জন্ম নিয়ন্ত্রণের কুফল :
জন্মনিয়ন্ত্রণের বহুবিদ কুফল রয়েছে। এ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হ’ল-
ব্যাভিচারের প্রসার :
ব্যাভিচার সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
وَلاَ تَقْرَبُواْ الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَّسَاءَ سَبِيْلاً
‘তোমরা অবৈধ যৌন সম্ভোগের নিকটবর্তী হয়ো না। এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ’ (ইসরা ১৭/৩২)
কিন্তু শয়তান মানুষকে দরিদ্রতার ভয় দেখিয়ে অসামাজিক, অনৈতিক কাজের প্রতি প্রলুব্ধ করে। নারী জাতি আল্লাহভীতির পাশাপাশি আরও একটি নৈতিকতা রক্ষা করতে বাধ্য হয়। তাহ’ল অবৈধ সন্তান জন্মের ফলে সামাজিক মর্যাদা বিনষ্ট হবার আশংকা। কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেয়ার ফলে, এ আশংকা থেকে একদম মুক্ত। যারা নৈশক্লাবে নাচ-গান করে, পতিতা বৃত্তি করে, প্রেমের নামে রঙ্গলীলায় মেতে উঠে, তারা অবৈধ সন্তান জন্মানোর আশংকা করে না। তাছাড়া কখনও হিসাব নিকাশে গড়মিল হয়ে অবৈধ সন্তান যদিও গর্ভে এসে যায়, তবে স্যাটেলাইট ক্লিনিক নামের সন্তান হত্যার গ্যারেজে গিয়ে প্রকাশ্যে গর্ভ নষ্ট করে ফেলে।
ইংল্যান্ডে প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে ৮৬ জন নারী বিয়ে ছাড়াই যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে। অবৈধ সন্তান জন্মের সময় এদের শতকরা ৪০ জন নারীর বয়স ১৮-১৯ বছর, ৩০ জন নারীর বয়স ২০ বছর এবং ২০ জন নারীর বয়স ২১ বছর। এরা তারাই যারা জন্মনিয়ন্ত্রণের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরও এ দুর্ঘটনাবশত গর্ভবতী হয়েছিল। [5] সেখানে প্রতি তিন জন নারীর একজন বিয়ের পূর্বে সতীত্ব সম্পদ হারিয়ে বসে। ডাঃ চেসার তার রচিত ‘সতীত্ব কি অতীতের স্মৃতি?’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে পরিষ্কার ভাষায় বর্ণনা করেছেন’। [6]
Indian Council for Medical Research-এর ডিরেক্টর জেনারেল অবতার সিংহ পেইন্টাল বলেন, We used to think our women were chaste, But people would be horrified at the level of promise culty here. অর্থাৎ আমাদের নারীদেরকে আমরা সতী বলে মনে করতাম। কিন্তু অবৈধ যৌনকর্ম এখানে এতবেশী বৃদ্ধি পেয়েছে যে, লোকে এতে ভীত না হয়ে পারে না। [7]
আমেরিকার বিদ্যালয় সমূহে অশ্লীল সাহিত্যের চাহিদা সর্বাপেক্ষা বেশী। যুবক-যুবতীরা এসব অধ্যয়ন করে অশালীন কাজে লিপ্ত হয়। এছাড়া হাইস্কুলের শতকরা ৪৫ জন ছাত্রী স্কুল ত্যাগ করার পূর্বে চরিত্রভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। আর এদের যৌন তৃষ্ণা অনেক বেশী। [8] বৃটেনেও শতকরা ৮৬ জন যুবতী বিয়ের সময় কুমারী থাকে না। [9] প্রাশ্চাত্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে তাদের শিক্ষা ব্যয়ের প্রায় অধিকাংশ খন্ডকালীন যৌনকর্মী হিসাবে অর্জন করে থাকে। মঙ্গোলয়েড দেশসমূহে যৌন সম্পর্কীয় বিধি-বিধান অত্যন্ত শিথিল। থাইল্যান্ডের ছাত্রীদের বিপুল যৌনতা লক্ষ্য করা যায়। [10]
চীনের ক্যান্টন শহরে কুমারীদের প্রেম বিষয়ে শিক্ষা দেয়ার জন্য বিদ্যালয় খোলা হয়েছে। [11] পশ্চিমা সভ্যতার পূজারীরা সর্বজনীন অবৈধ যৌন সম্পর্কের মহামারীর পথ প্রশস্ত করেছে। [12] চীনে যৌন স্বাধীনতার দাবী সম্বলিত পোষ্টারে যার সাথে খুশী যৌন মিলনে কুণ্ঠিত না হবার আহবান জানানো হয়। [13] ইউরোপে যৌন স্বাধীনতার দাবীতে পুরুষের মত নারীরাও নৈতিকতা হারিয়ে উচ্ছৃংখল ও অনাচারী এবং সুযোগ পেলেই হন্যে হয়ে তৃপ্ত করত যৌনক্ষুধা। অশুভ এই প্রবণতার ফলে বৈবাহিক জীবন ও পরিবারের প্রতি চরম অনিহা সৃষ্টি হয়। [14] অর্থ সাশ্রয়ের উদ্দেশ্যে আমেরিকার ৭৫ লাখ নারী পুরুষ বিবাহ ব্যতীত ‘লিভ টুগেদার’-এ। [15]
প্রাশ্চাত্যের যুবতীরা যাতে অপ্রত্যাশিতভাবে গর্ভবতী না হয়ে পড়ে, সেজন্য তাদেরকে যথেষ্ট পরিমাণে গর্ভনিরোধের দ্রব্যাদি দেয়া হয় এবং এ সকল দ্রব্য ব্যবহারের বিষয়ে তাদেরকে যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণও প্রদান করা হয়ে থাকে। এমনকি মায়েরা কন্যাদেরকে এই সকল দ্রব্য ব্যবহারের কায়দা-কৌশল শিক্ষা দিয়ে থাকে। গর্ভনিরোধ দ্রব্যাদির ব্যবহার সম্পর্কে স্কুল-কলেজে প্রচারপত্র বের করে এবং বিশেষ কোর্সেরও প্রবর্তন করে। এর অর্থ হ’ল- সকলেই নিঃসংকোচে মেনে নিয়েছে যে, যুবক-যুবতীরা অবৈধ যৌন সম্ভোগ করবেই। [16]
প্রাশ্চাত্যে ক্রমবর্ধমান অবৈধ যৌন স্বাধীনতাই সবচাইতে ক্ষতি সাধন করেছে। নারীর দেহকে বাণিজ্যিক রূপ দেয়ার কোন প্রচেষ্টাই বাকী রাখা হয়নি। অবিবাহিত মহিলাদের গর্ভধারণের সংখ্যা বৃদ্ধি, অবৈধ সন্তান জন্ম, গর্ভপাত, তালাক, যৌন অপরাধ ও যৌন ব্যাধিই এর প্রমাণ। অপর দিকে অবৈধ যৌন সম্পর্কের ফলে কোন আইন-বিচার ও আইনী শাস্তির বিধান নেই। বরং এটাকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে বিবেচনা করা হয়। [17]
সম্প্রতি ভারতেও অবৈধ যৌন সম্প্রীতি ও হিন্দু-মুসলমান যুবক-যুবতীর নির্বিঘ্নে বিবাহ বন্ধন এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণের নামে গর্ভপাত ঘটানোর হিড়িক পড়ে গেছে।
জটিল রোগের প্রাদুর্ভাব :
নারীর ব্যাভিচার দিনদিন প্রসার লাভ করে চলেছে। নারী স্বাধীনতার নামে এরা আরও বেপরোয়া হয়ে গেছে। এই অবৈধ যৌন সম্ভোগের মাধ্যমে নারী-পুরুষের মারাত্মক জটিল সব রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে।
জন্ম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে জীবাণু নাশক ঔষধ, পিল, কনডম ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহারের ফলে তৎক্ষণা কোন ক্ষতি হয় না। কিন্তু বেশ কিছু কাল যাবৎ এসব ব্যবহার করার ফলে মধ্যবর্তী বয়সে উপনীত হ’তে না হ’তেই নারী দেহের স্নায়ুতন্ত্রীতে বিশৃংখলা (Nervous instability) দেখা দেয়। যেমন- নিস্তেজ অবস্থা, নিরানন্দ, উদাসীনতা, রুক্ষমেজায, বিষণ্ণতা, নিদ্রাহীনতা, মস্তিষ্কের দুর্বলতা, হাত-পা অবশ, শরীরে ব্যথা, স্তনে সাইক্লিক্যাল ব্যথা, ক্যান্সার, অনিয়মিত ঋতু, সৌন্দর্য নষ্ট ইত্যাদি। [18] নারী-পুরুষ অবৈধ যৌন মিলনে সিফিলিস, প্রমেহ, গণরিয়া, এমনকি এইডস-এর মত মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যে সমস্ত বিবাহিতা নারীর দেহে অস্ত্রপচার করা হয়, তাদের শতকরা ৭৫ জনের মধ্যেই সিফিলিসের জীবাণু পাওয়া যায়। [19]
সিফিলিস রোগে আক্রান্ত রোগী সুচিকিৎসা গ্রহণ না করলে মারাত্মক সব রোগের সৃষ্টি হয়। এইডস রোগের ভাইরাসের নাম এইচ. আই. ভি (HIV)। এ ভাইরাস রক্তের শ্বেত কণিকা ধ্বংস করে। এ রোগ ১৯৮১ সালে প্রথম ধরা পড়ে এবং ১৯৮৩ সালে একজন ফরাসী বিজ্ঞানী এইচ. আই. ভি ভাইরাসকে এই রোগের কারণ হিসাবে দায়ী করেন। [20] বল্গাহীন ব্যাভিচারের ফলে এই রোগ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। ডাঃ হিরোশী নাকজিমা বলেন, জনসাধারণের মধ্যে এইডস বিস্তার লাভ করলে সমগ্র মানবজাতির বিলুপ্তি ঘটতে পারে। [21]
এছাড়া জন্ম নিরোধ পদ্ধতি ব্যবহার করার ফলে নানা প্রকার রোগ বদঅভ্যাসের প্রসার ঘটেছে। তন্মধ্যে কনডম ব্যবহার বা আযল করার জন্য নারীরা মিলনে পরিতৃপ্ত না হ’তে পেরে অবৈধ মিলনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। স্তনে সাইক্লিক্যাল ব্যথা, স্তনচাকা বা পিন্ড, স্তন ক্যান্সারের পূর্ব লক্ষণ। জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবনে স্তনে এ ধরনের ব্যথা ও পিন্ড তৈরী হয় এবং ৭৫% নারী স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকে। [22] বুক ও জরায়ুর কার্সিনোমা হ’তে পারে শর্করা জাতীয় খাদ্য সহ্য হয় না, লিভার দুর্বল হয়, রক্ত জমাট বাঁধতে ব্যহত হয়, বুকের দুধ কমে যায় এবং Lactation কম হয় এবং দেহে ফ্যাট জমা হয়। [23] এছাড়া জরায়ু ক্যান্সার ও স্থানচ্যুতি সহ আরও অনেক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জন্মের হার কমে যাওয়া :
আগত ও অনাগত সন্তান হত্যার ব্যাপারে মহান আল্লাহ নিষেধ করেন
وَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلاَقٍ
‘তোমরা অভাব ও দরিদ্রতার আশংকায় তোমাদের সন্তানদের হত্যা কর না’(ইসরা ১৭/৩১)
কিন্তু শয়তান আল্লাহর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলল,
وَلَأُضِلَّنَّهُمْ وَلَأُمَنِّيَنَّهُمْ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُبَتِّكُنَّ آذَانَ الأَنْعَامِ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللّهِ
‘আমি অবশ্যই তাদেরকে নির্দেশ দিব। আর তারা তদনুযায়ী সৃষ্টির কাঠামোতে রদবদল করবে’ (নিসা ৪/১১৯)
এই রদবদল শব্দের অর্থ খুঁজতে গেলে বর্তমান যুগের জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অন্যতম। আর জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের নামে যারা সন্তান হত্যা বা অনাগত ভবিষ্যত বংশধরদের হত্যা করে চলেছে, তারা সন্তানের জন্মকেই দারিদ্রের কারণ বলে চিহ্নিত করেছে। আর সেজন্যেই ক্রমশঃ জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলন নির্লজ্জভাবে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে করে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জ্যামিতিক হারে হরাস পেয়েছে। ভবিষ্যৎ বংশধর উৎপাদন ব্যাহত হ’লে মানব জাতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। যার ফলশ্রুতিতে মুনাফা অর্জনের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশী সক্রিয় হবে।
জাহেলী যুগে সন্তানের আধিক্য থেকে বাঁচার জন্য লোকেরা সন্তান প্রসবের সঙ্গে সঙ্গে তাকে হত্যা করত। গর্ভ নিরোধের প্রাচীন ও আধুনিক যত ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়েছে, সবগুলোই মানব বংশ ধ্বংসের পক্ষে কঠিন বিপদ বিশেষ। [24]
জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে ইউরোপ তাদের জন্য ভয়াবহ বিপদ বিবেচনা করেছে। [25] জন্মনিয়ন্ত্রণ জন্মহার হরাসের একমাত্র কারণ না হ’লেও অন্যতম প্রধান কারণ একথা নিশ্চিত। ইংল্যান্ডের রেজিষ্ট্রার জেনারেল নিজেই একথা স্বীকার করেছেন যে, জন্মহার হরাস পাওয়ার শতকরা ৭০ ভাগ জন্ম নিয়ন্ত্রণের দরুণ ঘটে থাকে। ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকাতে বলা হয়েছে, পাশ্চাত্য দেশসমূহের জন্ম হার হরাস প্রাপ্তির কারণ গুলোর মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের কৃত্রিম উপকরণাদির প্রভাব অত্যধিক। জন্মনিয়ন্ত্রণ ও ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবারকে সীমিত করার প্রবণতার কারণেই জন্মহার হরাস পাচ্ছে। [26]
ফ্রান্স সর্বপ্রথম ব্যাপকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের উপায় ও পদ্ধতিকে পরীক্ষা করেছে। একশত বছর পর সেখানে প্রতিটি যেলায় মৃত্যুহারের চেয়ে জন্মহার কমে যেতে থাকে। আর এই জনসংখ্যার হার কমে যাওয়ার ফলে দু’টি বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স এমন শোচনীয় পরাজয় বরণ করে যে, বিশ্বে তার প্রভাব প্রতিপত্তির সমাধি রচিত হয়। [27]
ফিডম্যান বলেন, সমষ্টিগতভাবে আমেরিকান শতকরা ৭০টি পরিবার জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আর বৃটেন ও আমেরিকার অবস্থা পর্যবেক্ষণে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, পরিবারগুলোর ক্ষুদ্র আকার প্রাপ্তির মূলে রয়েছে জন্মনিরোধের প্রচেষ্টা। [28] যদি ম্যালথাস আজ জীবিত থাকতেন, তাহ’লে এটা নিশ্চয়ই অনুভব করতেন যে, পাশ্চাত্যের লোকেরা জন্ম নিরোধ করার ব্যাপারে প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশী দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছে। পাশ্চাত্যের শিল্প ও নগর সভ্যতার কারণে অন্যান্য জাতিও বিপদের সম্মুখীন।
ইসলামের দৃষ্টিতে এর বিধান :
وَلاَ تَقْرَبُواْ الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَّسَاءَ سَبِيْلاً
‘তোমরা অবৈধ যৌন সম্ভোগের নিকটবর্তী হয়ো না। এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ’ (ইসরা ১৭/৩২)
وَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلاَقٍ
‘তোমরা অভাব ও দরিদ্রতার আশংকায় তোমাদের সন্তানদের হত্যা কর না’(ইসরা ১৭/৩১)
وَلَأُضِلَّنَّهُمْ وَلَأُمَنِّيَنَّهُمْ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُبَتِّكُنَّ آذَانَ الأَنْعَامِ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللّهِ
‘আমি অবশ্যই তাদেরকে নির্দেশ দিব। আর তারা তদনুযায়ী সৃষ্টির কাঠামোতে রদবদল করবে’ (নিসা ৪/১১৯)
মহান আল্লাহ পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করার ইচ্ছা পোষণ করে আদি পিতা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেন। কিন্তু মাতা হাওয়া (আঃ)-কে সৃষ্টির কোন প্রয়োজন ছিল কি? যদি একটু চিন্তা করি, তবে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মহান আল্লাহ আদম (আঃ)-এর একাকীত্ব দূর করতে জীবন সঙ্গিনী হিসাবে হাওয়া (আঃ)-কে শুধু সৃষ্টি করেননি। বরং আরও একটি বিশেষ কারণে তাঁকে সৃষ্টি করেছেন। তাহ’ল মহান আল্লাহ তাদের ঔরশজাত সন্তান দ্বারা সমগ্র পৃথিবী কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে দিতে চেয়েছেন। আর সমস্ত মানব তাঁর (আল্লাহর) একত্ব ঘোষণা পূর্বক দাসত্ব করবে। এ হ’ল আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর সৃষ্টির একান্ত উদ্দেশ্য। আমরা সেই অনাগত সন্তানদের নির্বিঘ্নে হত্যা করে চলেছি। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
َوَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلاَدَكُم مِّنْ إمْلاَقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা কর না দারিদ্রের কারণে, আমিই তোমাদের রিযিক দান করি এবং তাদেরও আমিই রিযিক দান করব’ (আন‘আম ৬/১৫১)
আলোচ্য আয়াতে খাবারের অভাবের আশংকায় অনাগত সন্তানকে হত্যা করতে মহান আল্লাহ স্পষ্ট নিষেধ করেছেন। আবার বললেন, ‘আমি তোমাদের রিযিক দান করি এবং তাদেরও আমিই দিব’। ‘আমিই দিব’ এই প্রতিশ্রুতির ব্যাখ্যা হ’ল অনাগত সন্তানদের রিযিকের মালিক আল্লাহ। তাঁর খাদ্য ভান্ডারে খাবারের হিসাব অকল্পনীয়। আবার তিনি বললেন,
‘নিশ্চয়ই তাদের হত্যা করা মারাত্মক ভুল’ (ইসরা ১৭/৩১)
তিনি যথার্থই বলেছেন, অনাগত সন্তান হত্যা করা বিরাট ভুল। ভূপৃষ্ঠে একচতুর্থাংশ স্থল, বাকী সব সাগর, মহাসাগর। কিন্তু বর্তমানে মহাসাগরে হাওয়াইন দ্বীপপুঞ্জের মত ছোট-বড় দ্বীপ জেগে উঠেছে এবং নদী ভরাট হয়ে চর জেগে উঠেছে। এভাবে আমাদের আবাদী জমি ও বাসস্থান বাড়ছে এতে কোন সন্দেহ নেই।
মহান আল্লাহ বলেন,
‘ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য ও সুখ-শান্তির উপাদান ও বাহন’ (কাহাফ ১৮/৪৬)
আল্লামা আলুসী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ধন-সম্পদ হচ্ছে প্রাণ বাঁচানোর উপায়। আর সন্তান হচ্ছে বংশ তথা মানব প্রজাতি রক্ষার মাধ্যম। [35]
জনৈক রুশ লেখক তার Biological Tragedy of Woman গ্রন্থে বলেছেন, নারী জন্মের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানববংশ রক্ষা করা। [36] যৌন প্রেরণার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য মানববংশ বৃদ্ধির সঙ্গে দেহের প্রতিটি অঙ্গ স্ব স্ব দায়িত্ব পালনে তৎপর। নারী দেহের বৃহত্তম অংশ গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মানোর উদ্দেশ্যেই সৃষ্ট। [37] মা হাওয়াসহ পৃথিবীর সমস্ত নারী সৃষ্টির উদ্দেশ্য মানব বংশ রক্ষা ও সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে পারিবারিক কাঠামোতে সন্তানের সুষ্ঠু লালন-পালন।
আযল-এর বিধান :
প্রাচীনকালে আরব সমাজে ‘আযল’ করার যে প্রচলন ছিল। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে কোন আলোচনা খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে হাদীছে স্পষ্ট আলোচনা আছে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হ’ল-
১. জাবির (রাঃ) বলেন,
كُنَّا نَعْزِلُ وَالْقُرْآنُ يَنْزِلُ‘আমরা রাসূলের জীবদ্দশায় ‘আযল’ করতাম অথচ তখনও কুরআন নাযিল হচ্ছিল। [38]
অর্থাৎ পবিত্র কুরআনে ‘আযল’ সম্পর্কে কোন নিষেধবাণী আসেনি। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও তা নিষেধ করেননি।
وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ: خَرَجْنَا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ غَزْوَةِ بَنِي الْمُصْطَلِقِ فَأَصَبْنَا سَبْيًا مِنْ سَبْيِ الْعَرَب فاشتهينا النِّسَاء واشتدت عَلَيْنَا الْعُزْبَةُ وَأَحْبَبْنَا الْعَزْلَ فَأَرَدْنَا أَنْ نَعْزِلَ وَقُلْنَا: نَعْزِلُ وَرَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَيْنَ أَظْهُرِنَا قَبْلَ أَنْ نَسْأَلَهُ؟ فَسَأَلْنَاهُ عَن ذَلِك فَقَالَ: مَا عَلَيْكُمْ أَلاَّ تَفْعَلُوْا مَا مِنْ نَسَمَةٍ كَائِنَةٍ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ إِلاَّ وَهِيَ كَائِنَةٌ-
২. আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন,
আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে বনী মুস্তালিকের যুদ্ধে বের হয়ে গেলাম। সেখানে কিছু সংখ্যক আরবকে (দাসী) বন্দী করে নিলাম। তখন আমাদের মধ্যে রমণীদের প্রতি আকর্ষণ জাগে। যৌন ক্ষুধাও তীব্র হয়ে উঠে এবং এ অবস্থায় ‘আযল করাকেই আমরা ভাল মনে করলাম। তখন এ সম্পর্কে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি জবাবে বললেন, তোমরা যদি তা কর তাতে তোমাদের ক্ষতি কি? কেননা আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ সৃষ্টি করবেন, তা তিনি নির্দিষ্ট করে রেখেছেন এবং তা অবশ্যই সৃষ্টি করবেন। [39]
৩. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
তুমি কি সৃষ্টি কর? তুমি কি রিযিক দাও? তাকে তার আসল স্থানেই রাখ, সঠিকভাবে তাকে থাকতে দাও। কেননা এ ব্যাপারে আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়ছালা রয়েছে। [40]
ইবনে সীরীন-এর মতে, لاعليكم ان لاتفعلوا এ বাক্যে ‘আযল’ সম্পর্কে স্পষ্ট নিষেধ না থাকলেও এ যে নিষেধের একেবারে কাছাকাছি এতে কোন সন্দেহ নেই। [41]
হাসান বছরী বলেন, আল্লাহর শপথ, রাসূলের একথায় ‘আযল’ সম্পর্কে স্পষ্ট ভৎর্সনা ও হুমকি রয়েছে। [42]
ইমাম কুরতুবী বলেছেন, ছাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত কথা থেকে নিষেধই বুঝেছিলেন। ফলে এর অর্থ দাঁড়ায় রাসূল (ছাঃ) যেন বলেছেন, لاتعزلوا وعليكم ان لاتفعلوا তোমরা ‘আযল’ কর না, তা না করাই তোমাদের কর্তব্য। [43]
রাগিব ইসফাহানীর মতে, ‘আযল’ করে শুক্র বিনষ্ট করা এবং তাকে তার আসল স্থানে নিক্ষেপ না করা সম্পর্কে স্পষ্ট নিষেধ। [44]
মুয়াত্তা গ্রন্থ প্রণেতা ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন যে, ইবনে ওমর (রাঃ) ছিলেন তাদের অন্যতম যাঁরা ‘আযল’ পসন্দ করতেন না। [45]
عزل অর্থ হ’ল, পুরুষাঙ্গ স্ত্রী অঙ্গের ভেতর থেকে বের করে নেয়া যেন শুক্র স্ত্রী অঙ্গের ভেতরে স্খলিত হওয়ার পরিবর্তে বাইরে স্খলিত হয়।[46]
আইয়ামে জাহেলিয়াতে যেসব কারণে সন্তান হত্যা করা হ’ত, বর্তমান যামানায় জন্মনিয়ন্ত্রণও ঠিক একই কারণে গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু সোনালী যুগের ‘আযল’-এর উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে যুগে তিনটি কারণে মুসলমানদের মধ্যে ‘আযল’-এর প্রচলন ছিল।
(এক) দাসীর গর্ভে নিজের কোন সন্তান জন্মানো তাঁরা পসন্দ করতেন না, সামাজিক হীনতার কারণে।
(দুই) দাসীর গর্ভে কারো সন্তান জন্মালে উক্ত সন্তানের মাকে হস্তান্তর করা যাবে না, অথচ স্থায়ীভাবে দাসীকে নিজের কাছে রেখে দিতেও তারা প্রস্ত্তত ছিল না।
(তিন) দুগ্ধপায়ী শিশুর মা পুনরায় গর্ভ ধারণ করার ফলে প্রথম শিশুর স্বাস্থ্যহানীর আশংকা অথবা পুনরায় সন্তান গর্ভে ধারণ করলে মায়ের স্বাস্থ্যের বিপর্যয়ের আশংকা, কিংবা সন্তান প্রসবের কষ্ট সহ্য করার অনুপযুক্ত তা চিকিৎসকের পরামর্শে যথাযোগ্য বিবেচনায় এক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
উপরোক্ত তিনটি কারণের মধ্যে প্রথম দু’টি কারণ আধুনিক যুগে বিলুপ্ত হয়েছে। শেষের তিন নম্বর কারণ ব্যতিরেকে সম্পদ সাশ্রয়ের জন্য ও নিজের আমোদ-প্রমোদের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ করা বৈধ নয়।
পরিশেষে বলব, জন্মনিয়ন্ত্রণ জনসংখ্যা বিস্ফোরণ সমস্যার প্রকৃত সমাধান নয়। বরং জনসংখ্যাকে দক্ষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তর ও উৎপাদন বাড়ানো, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপকরণাদির উন্নয়ণের মধ্যেই রয়েছে এ সমস্যার প্রকৃত সমাধান। জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের অর্থ হচ্ছে না বুঝে পরাজয় বরণ করা। একটি কাপড় কারো শরীরে ঠিকমত ফিট না হ’লে কাপড়টি বড় করার পরিবর্তে মানুষটির শরীর কেটে ছেঁটে ছোট করার মতই জন্মনিরোধ ব্যবস্থা অন্যায় ও অস্বাভাবিক। কেননা বিজ্ঞানের যুগে আমরা মানুষের যোগ্যতা অনুযায়ী তার শ্রমশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারি। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!!