ইউসুফ (আ:)এর পিতা ও ভাইদের
সাথে পূনঃরমিলন অধ্যায়:
ইউসুফের ভাইরো মিসরে এলো এবং তার কাছে হাযির হলো৷ সে তাদেরকে চিনে ফেললো৷ কিন্তু তারা তাকে চিনতে পারলো না৷ইউসুফের ভাইয়েরা যে ইউসুফকে চিনতে পারেনি এটা কোন অযৌক্তিক বা অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। যে সময় তারা তাঁকে কূয়ায় ফেলে দিয়েছিল তখন তিনি ছিলেন সতের বছর বয়সের একটি কিশোর মাত্র। আর এখন তাঁর বয়স আটতিরিশ বছরের কাছাকাছি। এর দীর্ঘ সময়ে মানুষের চেহারার কাঠামোয় অনেক পরিবর্তন আসে। তাছাড়া যে ভাইকে তারা কূয়ায় ফেলে দিয়েছিল সে আজ মিসরের অধিপতি হবে, একথা তারা কল্পনাও করতে পারেনি।তারপর সে যখন তাদের জিনিসপত্র তৈরী করালো তখন চলার সময় তাদেরকে বললো, “তোমাদের বৈমাত্রেয় ভাইয়ে আমাদের কাছে আনবে, দেখছো না আমি কেমন পরিমাপ পাত্র ভরে দেই এবং আমি কেমন ভালো অতিথিপরায়ণ ? যদি তোমরা তাকে না আনো তাহলে আমার কাছে তোমাদের জন্য কোন শস্য নেই বরং তোমরা আমার ধারেকাছেও এসো না৷” বর্ণনা সংক্ষেপের কারণে হয়তো কারো পক্ষে একথা অনুধাবন করা কঠিন হয়ে পড়ছে যে, হযরত ইউসুফ যখন নিজের ব্যক্তিত্বকে তাদের সামনে প্রকাশ করতে চাচ্ছিলেন না তখন আবার তাদের বৈমাত্রেয় ভাইয়ের কথা এলো কেমন করে৷ এবং তাকে আনার ব্যাপারে তাঁর এত বেশী পীড়াপীড়ি করারই বা অর্থ কি৷ কেননা, এভাবে তো রহস্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল। কিন্তু সামান্য চিন্তা করলে একথা পরিষ্কার বুঝা যায়। সেখানে খাদ্যশস্যের নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা ছিল এবং প্রত্যেক ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য গ্রহণ করতে পারতো। শস্য নেবার জন্য তারা দশ ভাই এসেছিল। কিন্তু তারা তাদের পিতার ও একাদশতম ভাইয়ের অংশও হয়তো চেয়েছিল। একথায় হযরত ইউসুফ (আ) বলে থাকবেন, বুঝলাম তোমাদের পিতার না আসার জন্য যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ এবং তার ওপর চোখে দেখতে পান না, ফলে তাঁর পক্ষে সশরীরে আসা সম্ভব নয়। কিন্তু ভাইয়ের না আসার কি ন্যায়সঙ্গত কারণ থাকতে পারে৷ এমন তো নয় যে, একজন বানোয়াট ভাইয়ের নাম করে অতিরিক্ত শস্য সংগ্রহ করে তোমরা অবৈধ্য ব্যবসায়ে নামার চেষ্টা করছো৷ জওয়াবে তারা হয়তো নিজেদের গৃহের অবস্থা বর্ণনা করেছে। তারা বলে থাকবে, সে আমাদের বৈমাত্রেয় ভাই। কিছু অসুবিধার কারণে পিতা তাকে আমাদের সাথে পাঠাতে ইতস্তত করেন। তাদের এসব কথায় হযরত ইউসুফ সম্ভবত বলেছেন, যাক এবারের জন্য তো আমি তোমাদের কথা বিশ্বাস করে পূর্ণ শস্য দিয়ে দিলাম কিন্তু আগামীতে তোমরা যদি তাকে সংগে করে না আনো তাহলে তোমাদের ওপর থেকে আস্থা উঠে যাবে এবং এখান থেকে তোমরা আর কোন শস্য পাবে না। এ শাসক সুলভ হুমকি দেবার সাথে সাথে তিনি নিজের দাক্ষিণ ও মেহমানদারীর মাধ্যমে তাদেরকে বশীভূত করার চেষ্টা করেন। কারণ নিজের ছোট ভাইকে দেখার এবং ঘরের অবস্থা জানার জন্য তাঁর মন অস্থির হয়ে তারা বললো, “আমরা চেষ্টা করবো যাতে আব্বাজান তাকে পাঠাতে রাযী হয়ে যান এবং আমরা নিশ্চয়ই এমনটি করবো৷” ইউসুফ নিজের গোলামদেরকে ইশারা করে বললো, “ওরা শস্যের বিনিময়ে যে অর্থ দিয়েছে তা চুপিসারে ওদের জিনিসপত্রের মধ্যেই রেখে দাও৷” ইউসুফ এটা করলো এ আশায় যে, বাড়িতে পৌঁছে তারা নিজেদের ফেরত পাওয়া অর্থ চিনতে পারবে (অথবা এ দানশীলতার ফলে তারা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হবে) এবং বিচিত্র নয় যে, তারা আবার ফিরে আসবে৷ যখন তারা তাদের বাপের কাছে ফিরে গেলো তখন বললো, “আব্বাজান! আগামীতে আমাদের শস্য দিতে অস্বীকার করা হয়েছে, কাজেই আমাদের ভাইকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন, যাতে আমরা শস্য নিয়ে আসতে পারি এবং অবশ্যি আমরা হেফাজতের জন্য দায়ী থাকবো৷” বাপ জবাব দিল, “আমি কি ওর ব্যাপারে তোমাদের ওপর ঠিক তেমনি ভরসা করবো যে, ইতিপূর্বে তার ভাইয়ের ব্যাপারে করেছিলাম ? অবশ্য আল্লাহ সবচেয়ে ভালো হেফাজতকারী এবং তিনি সবচেয়ে বেশী করুণাশীল৷” তারপর যখন তারা নিজেদের জিনিসপত্র খুললো, তারা দেখলো তাদের অর্থও তাদেরকে ফেরত দেয়া হয়েছে৷ এ দৃশ্য দেখে তারা চিৎকার করে উঠলো, “আব্বাজান, আমাদের আর কী চাই ! দেখুন এই আমাদের অর্থও আমাদের ফেরত দেয়া হয়েছে৷ ব্যস্ এবার আমরা যাবো আর নিজেদের পরিজনদের জন্য রসদ নিয়ে আসবো, নিজেদের ভাইয়ের হেফাজতও করবো এবং অতিরিক্ত একটি উট বোঝাই করে শস্যও আনবো, এ পরিমাণ শস্য বৃদ্ধি অতি সহজেই হয়ে যাবে৷” তাদের বাপ বললো, “আমি কখনোই তাকে তোমাদের সাথে পাঠাবো না যতক্ষণ না তোমরা আল্লাহর নামে আমার কাছে অংগীকার করবে৷ এ মর্মে যে তাকে নিশ্চয়ই আমার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে তবে হাঁ যদি কোথাও তোমরা ঘেরাও হয়ে যাও তাহলে ভিন্ন কথা৷” যখন তারা তার কাছে অংগীকার করলো তখন সে বললো, “দেখো আল্লাহ আমাদের একথার রক্ষক৷” তারপর সে বললো, “হে আমার সন্তানরা! মিসরের রাজধানীতে এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করো না বরং বিভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করো৷কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা থেকে আমি তোমাদের বাঁচাতে পারি না৷ তাঁর ছাড়া আর কারোর হুকুম চলে না, তাঁর ওপরই আমি ভরসা করি এবং যার ভরসা করতে হয় তাঁর ওপরই করতে হবে৷” আর ঘটনাক্ষেত্রে তা-ই হলো, যখন তারা নিজেদের বাপের নির্দেশ মতো শহরে (বিভিন্ন দরজা দিয়ে) প্রবেশ করল তখন তার এ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা আল্লাহর ইচ্ছার মোকাবিলায় কোন কাজে লাগলো না৷ তবে হাঁ, ইয়াকূবের মনে যে একটি খটকা ছিল তা দূর করার জন্য সে নিজের মনমতো চেষ্টা করে নিল৷ অবশ্যি সে আমার দেয়া শিক্ষায় জ্ঞানবান ছিল কিন্তু অধিকাংশ লোক প্রকৃত সত্য জানে না৷ তারা ইউসুফের কাছে পৌঁছলে সে সহোদর ভাইকে নিজের কাছে আলাদা করে ডেকে নিল এবং তাকে বললো, “আমি তোমার সেই (হারানো) ভাই, এখন আর সেসব আচরণের জন্য দুঃখ করো না যা এরা করে এসেছে” একুশ বাইশ বছরের ব্যবধান দু'ভাইয়ের পূনরমিলনের পর যে অবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকবে এ বাক্যে তার সম্পূর্ণ চেহারাটাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে । হযরত ইউসূফ (আ)নিজের অবস্থা বর্ণনা করে কোন কোন অবস্থার মধ্য দিয়ে তিনি আজকের এ মর্যাদায় পৌঁছেছেন তা বলে থাকবেন। বিন ইয়ামীন বর্ণনা করে থাকবেন তাঁর অন্তরধানের পর বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা তার সাথে কেমনতর দুর্ব্যবহার করেছে। হযরত ইউসুফ (আ) ভাইকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়ে থাকবেন, এখন থেকে তুমি আমার কাছেই থাকবে, এ জালেমদের খপ্পরে তোমাকে আর দ্বিতীয়বার পড়তে দেবো না। সম্ভবত এ সময়ই বিন ইয়ামীনকে মিসরে আটকে রাখার জন্য কি ব্যাবস্থা অবলম্বন করা হবে এবং প্রয়োজনের খাতিরে এখন তা গোপন রাখতে হবে এ ব্যাপারে আলোচনার পর দু'ভাই একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান। যখন ইউসুফ তাদের মালপত্র বোঝাই করাতে লাগলো তখন নিজের ভাইয়ের মালপত্রের মধ্যে নিজের পেয়ালা রেখে দিল৷ তারপর একজন নকীব চীৎকার করে বললো, “হে যাত্রীদল! তোমরা চোর৷” সম্ভবত পেয়ালা রেখে দেবার কাজটা হযরত ইউসুফ (আ) নিজের ভাইয়ের সম্মতি নিয়ে তার জ্ঞাতসারেই করেছিলেন। আগের আয়াতে এ দিকে ইংগিত করা হয়েছে। হযরত ইউসুফ (আ) দীর্ঘকালীন বিচ্ছেদের পর জালেম বৈমাত্রের ভাইয়ের হাত থেকে নিজের সহোদর ভাইকে রক্ষা করতে চাচ্ছিলেন। ভাই নিজেও এ জালেমদের সাথে ফিরে না যেতে চেয়ে থাকবেন। হযরত ইউসুফের নিজের পরিচয় প্রকাশ না করে তাকে প্রকাশ্যে আটকে রাখা এবং তার মিসরে থেকে যাওয়া সম্ভব ছিল না। আর এ অবস্থায় এ পরিচয় প্রকাশ করাটা কল্যাণকর ছিল না। তাই বিন ইয়ামীনকে আটকে রাখার জন্য দু'ভাইয়ের মধ্যে এ পরামর্শ হয়ে থাকবে। যদিও এর মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য ভাইয়ের অপমান অনিবার্য ছিল, কারণ তার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ আনা হচ্ছিল, কিন্তু পরে উভয় ভাই মিলে আসল ব্যাপারটি জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিলেই এ কলংকের দাগ অতি সহজেই মুছে ফেলা যেতে পারবে।তারা পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলো, “ তোমাদের কি হারিয়ে গেছে ?” সরকারী কর্মচারী বললো, “আমরা বাদশাহার পানপাত্র পাচ্ছি না,” (এবং তাদের জমাদার বললো :) “যে ব্যক্তি তা এনে দেবে তার জন্য রয়েছে পুরস্কার এক উট বোঝাই মাল৷ আমি এর দায়িত্ব নিচ্ছি৷” এ ভাইয়েরা বললো, “আল্লাহর কসম! তোমরা খুব ভালোভাবেই জানো, আমরা এ দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে আসিনি এবং চুরি করার মতো লোক আমরা নই” তারা বললো, “আচ্ছা, যদি তোমাদের কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলে চোরের কি শাস্তি হবে ?” তারা জবাব দিল, “তার শাস্তি” যার মালপত্রের মধ্যে ঐ জিনিস পাওয়া যাবে তার শাস্তি হিসেবে তাকেই রেখে দেয়া হবে৷ আমাদের এখানে তো এটাই এ ধরনের জালেমদের শাস্তির পদ্ধতি৷” উল্লেখ্য, এ ভাইয়েরা ছিল ইবরাহিমী পরিবারের সন্তান। কাজেই চুরির ব্যাপারে তারা যে আইনের কথা বলে তা ছিল ইবরাহিমী শরীয়াতের আইন। এ আইন অনুযায়ী চোরের শাস্তি ছিল, যে ব্যক্তির সম্পদ সে চুরি করেছে তাকে তার দাসত্ব করতে হবে।তখন ইউসুফ নিজের ভাইয়ের আগে তাদের থলের তল্লাশী শুরু করে দিল৷ তারপর নিজের ভাইয়ের থলের মধ্য থেকে হারানো জিনিস বের করে ফেললো৷ - এভাবে আমি নিজের কৌশলের মাধ্যমে ইউসুফকে সহায়তা করলাম৷ বাদশাহর দীন (অর্থাৎ মিসরের বাদশাহর আইন) অনুযায়ী নিজের ভাইক পাকড়াও করা তার পক্ষে সংগত ছিল না, তবে যদি আল্লাহই এমনটি চান৷যাকে চাই তার মর্তবা আমি বুলন্দ করে দেই আর একজন জ্ঞানবান এমন আছে যে প্রত্যেক জ্ঞানবানের চেয়ে জ্ঞানী৷ এ ভাইয়েরা বললো, “এ যদি চুরি করে থাকে তাহলে অবাক হবার কিছু নেই, কারণ এর আগে এর ভাইও (ইউসুফ) চুরি করেছিল৷” ইউসুফ তাদের একথা শুনে আতস্থ করে ফেললো, সত্য তাদের কাছে প্রকাশ করলো না শুধুমাত্র (মনে মনে) এতটুকু বলে থেমে গেলো, “বড়ই বদ তোমরা (আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার ওপর এই যে দোষারোপ তোমরা করছো সে সম্পর্কে আল্লাহ প্রকৃত সত্য ভালোভাবে অবগত৷” তারা বললো, “হে ক্ষমাতাসীন সরদার (আযীয)! এর বাপ অত্যন্ত বৃদ্ধ, এর জায়গায় আপনি আমাদের কাউকে রেখে দিন৷ আমরা আপনাকে বড়ই সদাচারী ব্যক্তি হিসেবে পেয়েছি৷” ইউসুফ বললেন, “আল্লাহর পানাহ! অন্য কাউকে আমরা কেমন করে রাখতে পারি ? যার কাছে আমরা নিজেদের জিনিস পেয়েছি তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য কাউকে রাখলে আমরা জালেম হয়ে যাবো৷” যখন তারা ইউসুফের কাছ থেকে নিরাশ হয়ে গেলো তখন একান্তে পরামর্শ করতে লাগলো৷ তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বয়সে বড় ছিল সে বললো : “তোমরা কি জান না, তোমাদের বাপ তোমাদের কাছ থেকে আল্লাহর নামে কি অংগীকার নিয়েছেন এবং ইতিপূর্বে ইউসুফের ব্যাপারে তোমরা যেসব বাড়াবাড়ি করেছো তাও তোমরা জানো৷ এখন আমি তো এখান থেকে কখনোই যাবো না যে পর্যন্ত না আমার বাপ আমাকে অনুমতি দেন অথবা আল্লাহ আমার ব্যাপারে কোন ফায়সালা করে দেন, কেননা তিনি সবচেয়ে ভালো ফায়সালাকারী৷ তোমরা তোমাদের বাপের কাছে ফিরে গিয়ে বলো, “আব্বাজান, আপনার ছেলে চুরি করেছে, আমরা তাকে চুরি করতে দেখিনি, যতটুকু আমরা জেনেছি শুধু ততটুকুই বর্ণনা করছি এবং অদৃশ্যেরই রক্ষণাবেক্ষণ করা তো আমাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না৷ আমরা যে পল্লীতে ছিলাম সেখানকার লোকজনদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখুন এবং যে কাফেলার সাথে আমরা ছিলাম তাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, আমরা যা বলছি৷” ইয়াকূব এ কাহিনী শুনে বললো, “আসলে তোমাদের মন তোমাদের জন্য আরো একটি বড় ঘটনাকে সহজ করে দিয়েছে৷ ঠিক আছে, এ ব্যাপারেও আমি সবর করবো এবং ভালো করেই করবো৷ হয়তো আল্লাহ এদের সবাইকে এনে আমার সাথে মিলিয়ে দেবেন৷ তিনি সবকিছু জানেন এবং তিনি জ্ঞানের ভিত্তিতে সমস্ত কাজ করেন৷” তারপর সে তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বসে গেলো এবং বলতে লাগলো, “হায় ইউসুফ”- সে মনে মনে দুঃখে ও শোকে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছিল এবং তার চোখগুলো সাদা হয়ে গিয়েছিল, ছেলেরা বললো, “আল্লাহর দোহাই! আপনি তো শুধু ইউসুফের কথাই স্মরণ করে যাচ্ছেন৷ অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, তার শোকে আপনি নিজেকে দিশেহারা করে ফেলবেন অথবা নিজের প্রাণ সংহার করবেন৷” সে বললো, “আমি আমার পেরেশানি এবং আমার দুঃখের ফরিয়াদ আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে করছি না৷ আর আল্লাহর ব্যাপারে আমি যতটুকু জানি তোমরা ততটুকু জানো না৷ হে আমার ছেলেরা! তোমরা যাও এবং ইউসুফ ও তার ভাইয়ের ব্যাপারে কিছু অনুসন্ধান চালাও৷ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না৷ তাঁর রহমত থেকে তো একমাত্র কাফেররাই নিরাশ হয়৷” যখন তারা মিসরে গিয়ে ইউসুফের সামনে হাযির হলো তখন আরয করলো, “হে পরাক্রান্ত শাসক! আমরা ও আমাদের পরিবার পরিজন কঠিন বিপদের মুখোমুখি হয়েছি এবং আমরা মাত্র সামান্য পুঁজি নিয়ে এসেছি৷ আপনি আমাদের পূর্ণমাত্রায় শস্য দিয়ে দিন এবং আমাদেরকে দান করুন, আল্লাহ দানকারীদেরকে প্রতিদান দেন৷” (একথা শুনে ইউসুফ আর চুপ থাকতে পারলো না) সে বললো, “তোমরা কি জানো, তোমরা ইউসুফ ও তার ভাইয়ের সাথে কি ব্যবহার করেছিলে, যখন তোমরা অজ্ঞ ছিলে ?” তারা চমকে উঠে বললো, “হায় তুমিই ইউসুফ নাকি ?” সে বললো, “হাঁ, আমি ইউসুফ এবং এই আমার সহোদর৷ আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন৷ আসলে সেউ যদি তাকওয়া ও ছবর অবলম্বন করে তাহলে আল্লাহর কাছে এ ধরণের সৎলোকদের কর্মফল নষ্ট হয়ে যায় না৷” তারা বললো, “আল্লাহর কসম, আল্লাহ তোমাকে আমাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং যথার্থই আমরা অপরাধী ছিলাম৷” সে জবাব দিল, “আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই৷ আল্লাহ তোমাদের মাফ করে দিন৷ তিনি সবার প্রতি অনুগ্রহকারী৷ যাও, আমার এ জামাটি নিয়ে যাও এবং এটি আমার পিতার চেহারার ওপর রেখো, তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন৷ আর তোমাদের সমস্ত পরিবার পরিজনকে আমার কাছে নিয়ে এসো৷” কাফেলাটি যখন (মিসর থেকে) রওয়ানা দিল তখন তাদের বাপ (কেনানে) বললো, “আমি ইউসুফের গন্ধ পাচ্ছি, তোমরা যেন আমাকে একথা বলো না যে, বুড়ো বয়সে আমার বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়েছে৷” ঘরের লোকরো বললো, “আল্লাহর কসম, আপনি এখনো নিজের সেই পুরাতন পাগলামি নিয়েই আছেন৷”তারপর যখন সুখবর বহনকারী এলো তখন সে ইউসুফের জামা ইয়াকূবের চেহারার ওপর রাখলো এবং অকস্মাত তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে এলো৷ তখন সে বললো, “আমি না তোমাদের বলেছিলাম, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন সব কথা জানি যা তোমরা জানো না ?” সবাই বলে উঠলো, “আব্বাজান৷ আপনি আমাদের গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করুন, সত্যিই আমরা অপরাধী ছিলাম৷” তিনি বললেন, “আমি আমার রবের কাছে তোমাদের মাগফেরাতের জন্য আবেদন জানাবো, তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়৷” তারপর যখন তারা ইউসুফের কাছে পৌঁছুলো তখন সে নিজের বাপ-মাকে নিজের কাছে বসালো এবং (নিজের সমগ্র পরিবার পরিজনকে) বললো, “চলো, এবার শহরে চলো, আল্লাহ চাহেতো শান্তি ও নিরপত্তার মধ্যে বসবাস করবে৷” (শহরে প্রবেশ করার পর) সে নিজের বাপ-মাকে উঠিয়ে নিজের পাশে সিংহাসনে বসালো এবং সবাই তার সামনে স্বতস্ফূর্তভাবে সিজদায় ঝুঁকে পড়লো৷ ইউসুফ বললো, “আব্বাজান! আমি ইতিপুর্বে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম এ হচ্ছে তার তা’বীর৷ আমার রব তাকে সত্য পরিণত করেছেন ৷ আমার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ হিসেবে তিনি আমাকে কারাগার থেকে বের করেছেন এবং আপনাদেরকে মরু অঞ্চল থেকে এনে আমার সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন৷ আসলে আমার রব অননুভূত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করেন৷ নিসন্দেহে তিনি সবকিছু জানেন ও সুগভীর প্রজ্ঞার অধিকারী৷ হে আমার রব! তুমি আমাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করেছো এবং আমাকে কথার গভীরে প্রবেশ করা শিখিয়েছো৷ হে আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা! দুনিয়ায় ও আখেরাতে তুমিই আমার অভিভাবক৷ ইসলামের ওপর আমাকে মৃত্যু দান করো এবং পরিণামে আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তরভূক্ত করো৷”
ইউসুফের ভাইরো মিসরে এলো এবং তার কাছে হাযির হলো৷ সে তাদেরকে চিনে ফেললো৷ কিন্তু তারা তাকে চিনতে পারলো না৷ইউসুফের ভাইয়েরা যে ইউসুফকে চিনতে পারেনি এটা কোন অযৌক্তিক বা অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। যে সময় তারা তাঁকে কূয়ায় ফেলে দিয়েছিল তখন তিনি ছিলেন সতের বছর বয়সের একটি কিশোর মাত্র। আর এখন তাঁর বয়স আটতিরিশ বছরের কাছাকাছি। এর দীর্ঘ সময়ে মানুষের চেহারার কাঠামোয় অনেক পরিবর্তন আসে। তাছাড়া যে ভাইকে তারা কূয়ায় ফেলে দিয়েছিল সে আজ মিসরের অধিপতি হবে, একথা তারা কল্পনাও করতে পারেনি।তারপর সে যখন তাদের জিনিসপত্র তৈরী করালো তখন চলার সময় তাদেরকে বললো, “তোমাদের বৈমাত্রেয় ভাইয়ে আমাদের কাছে আনবে, দেখছো না আমি কেমন পরিমাপ পাত্র ভরে দেই এবং আমি কেমন ভালো অতিথিপরায়ণ ? যদি তোমরা তাকে না আনো তাহলে আমার কাছে তোমাদের জন্য কোন শস্য নেই বরং তোমরা আমার ধারেকাছেও এসো না৷” বর্ণনা সংক্ষেপের কারণে হয়তো কারো পক্ষে একথা অনুধাবন করা কঠিন হয়ে পড়ছে যে, হযরত ইউসুফ যখন নিজের ব্যক্তিত্বকে তাদের সামনে প্রকাশ করতে চাচ্ছিলেন না তখন আবার তাদের বৈমাত্রেয় ভাইয়ের কথা এলো কেমন করে৷ এবং তাকে আনার ব্যাপারে তাঁর এত বেশী পীড়াপীড়ি করারই বা অর্থ কি৷ কেননা, এভাবে তো রহস্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল। কিন্তু সামান্য চিন্তা করলে একথা পরিষ্কার বুঝা যায়। সেখানে খাদ্যশস্যের নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা ছিল এবং প্রত্যেক ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য গ্রহণ করতে পারতো। শস্য নেবার জন্য তারা দশ ভাই এসেছিল। কিন্তু তারা তাদের পিতার ও একাদশতম ভাইয়ের অংশও হয়তো চেয়েছিল। একথায় হযরত ইউসুফ (আ) বলে থাকবেন, বুঝলাম তোমাদের পিতার না আসার জন্য যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ এবং তার ওপর চোখে দেখতে পান না, ফলে তাঁর পক্ষে সশরীরে আসা সম্ভব নয়। কিন্তু ভাইয়ের না আসার কি ন্যায়সঙ্গত কারণ থাকতে পারে৷ এমন তো নয় যে, একজন বানোয়াট ভাইয়ের নাম করে অতিরিক্ত শস্য সংগ্রহ করে তোমরা অবৈধ্য ব্যবসায়ে নামার চেষ্টা করছো৷ জওয়াবে তারা হয়তো নিজেদের গৃহের অবস্থা বর্ণনা করেছে। তারা বলে থাকবে, সে আমাদের বৈমাত্রেয় ভাই। কিছু অসুবিধার কারণে পিতা তাকে আমাদের সাথে পাঠাতে ইতস্তত করেন। তাদের এসব কথায় হযরত ইউসুফ সম্ভবত বলেছেন, যাক এবারের জন্য তো আমি তোমাদের কথা বিশ্বাস করে পূর্ণ শস্য দিয়ে দিলাম কিন্তু আগামীতে তোমরা যদি তাকে সংগে করে না আনো তাহলে তোমাদের ওপর থেকে আস্থা উঠে যাবে এবং এখান থেকে তোমরা আর কোন শস্য পাবে না। এ শাসক সুলভ হুমকি দেবার সাথে সাথে তিনি নিজের দাক্ষিণ ও মেহমানদারীর মাধ্যমে তাদেরকে বশীভূত করার চেষ্টা করেন। কারণ নিজের ছোট ভাইকে দেখার এবং ঘরের অবস্থা জানার জন্য তাঁর মন অস্থির হয়ে তারা বললো, “আমরা চেষ্টা করবো যাতে আব্বাজান তাকে পাঠাতে রাযী হয়ে যান এবং আমরা নিশ্চয়ই এমনটি করবো৷” ইউসুফ নিজের গোলামদেরকে ইশারা করে বললো, “ওরা শস্যের বিনিময়ে যে অর্থ দিয়েছে তা চুপিসারে ওদের জিনিসপত্রের মধ্যেই রেখে দাও৷” ইউসুফ এটা করলো এ আশায় যে, বাড়িতে পৌঁছে তারা নিজেদের ফেরত পাওয়া অর্থ চিনতে পারবে (অথবা এ দানশীলতার ফলে তারা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হবে) এবং বিচিত্র নয় যে, তারা আবার ফিরে আসবে৷ যখন তারা তাদের বাপের কাছে ফিরে গেলো তখন বললো, “আব্বাজান! আগামীতে আমাদের শস্য দিতে অস্বীকার করা হয়েছে, কাজেই আমাদের ভাইকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন, যাতে আমরা শস্য নিয়ে আসতে পারি এবং অবশ্যি আমরা হেফাজতের জন্য দায়ী থাকবো৷” বাপ জবাব দিল, “আমি কি ওর ব্যাপারে তোমাদের ওপর ঠিক তেমনি ভরসা করবো যে, ইতিপূর্বে তার ভাইয়ের ব্যাপারে করেছিলাম ? অবশ্য আল্লাহ সবচেয়ে ভালো হেফাজতকারী এবং তিনি সবচেয়ে বেশী করুণাশীল৷” তারপর যখন তারা নিজেদের জিনিসপত্র খুললো, তারা দেখলো তাদের অর্থও তাদেরকে ফেরত দেয়া হয়েছে৷ এ দৃশ্য দেখে তারা চিৎকার করে উঠলো, “আব্বাজান, আমাদের আর কী চাই ! দেখুন এই আমাদের অর্থও আমাদের ফেরত দেয়া হয়েছে৷ ব্যস্ এবার আমরা যাবো আর নিজেদের পরিজনদের জন্য রসদ নিয়ে আসবো, নিজেদের ভাইয়ের হেফাজতও করবো এবং অতিরিক্ত একটি উট বোঝাই করে শস্যও আনবো, এ পরিমাণ শস্য বৃদ্ধি অতি সহজেই হয়ে যাবে৷” তাদের বাপ বললো, “আমি কখনোই তাকে তোমাদের সাথে পাঠাবো না যতক্ষণ না তোমরা আল্লাহর নামে আমার কাছে অংগীকার করবে৷ এ মর্মে যে তাকে নিশ্চয়ই আমার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে তবে হাঁ যদি কোথাও তোমরা ঘেরাও হয়ে যাও তাহলে ভিন্ন কথা৷” যখন তারা তার কাছে অংগীকার করলো তখন সে বললো, “দেখো আল্লাহ আমাদের একথার রক্ষক৷” তারপর সে বললো, “হে আমার সন্তানরা! মিসরের রাজধানীতে এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করো না বরং বিভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করো৷কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা থেকে আমি তোমাদের বাঁচাতে পারি না৷ তাঁর ছাড়া আর কারোর হুকুম চলে না, তাঁর ওপরই আমি ভরসা করি এবং যার ভরসা করতে হয় তাঁর ওপরই করতে হবে৷” আর ঘটনাক্ষেত্রে তা-ই হলো, যখন তারা নিজেদের বাপের নির্দেশ মতো শহরে (বিভিন্ন দরজা দিয়ে) প্রবেশ করল তখন তার এ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা আল্লাহর ইচ্ছার মোকাবিলায় কোন কাজে লাগলো না৷ তবে হাঁ, ইয়াকূবের মনে যে একটি খটকা ছিল তা দূর করার জন্য সে নিজের মনমতো চেষ্টা করে নিল৷ অবশ্যি সে আমার দেয়া শিক্ষায় জ্ঞানবান ছিল কিন্তু অধিকাংশ লোক প্রকৃত সত্য জানে না৷ তারা ইউসুফের কাছে পৌঁছলে সে সহোদর ভাইকে নিজের কাছে আলাদা করে ডেকে নিল এবং তাকে বললো, “আমি তোমার সেই (হারানো) ভাই, এখন আর সেসব আচরণের জন্য দুঃখ করো না যা এরা করে এসেছে” একুশ বাইশ বছরের ব্যবধান দু'ভাইয়ের পূনরমিলনের পর যে অবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকবে এ বাক্যে তার সম্পূর্ণ চেহারাটাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে । হযরত ইউসূফ (আ)নিজের অবস্থা বর্ণনা করে কোন কোন অবস্থার মধ্য দিয়ে তিনি আজকের এ মর্যাদায় পৌঁছেছেন তা বলে থাকবেন। বিন ইয়ামীন বর্ণনা করে থাকবেন তাঁর অন্তরধানের পর বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা তার সাথে কেমনতর দুর্ব্যবহার করেছে। হযরত ইউসুফ (আ) ভাইকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়ে থাকবেন, এখন থেকে তুমি আমার কাছেই থাকবে, এ জালেমদের খপ্পরে তোমাকে আর দ্বিতীয়বার পড়তে দেবো না। সম্ভবত এ সময়ই বিন ইয়ামীনকে মিসরে আটকে রাখার জন্য কি ব্যাবস্থা অবলম্বন করা হবে এবং প্রয়োজনের খাতিরে এখন তা গোপন রাখতে হবে এ ব্যাপারে আলোচনার পর দু'ভাই একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান। যখন ইউসুফ তাদের মালপত্র বোঝাই করাতে লাগলো তখন নিজের ভাইয়ের মালপত্রের মধ্যে নিজের পেয়ালা রেখে দিল৷ তারপর একজন নকীব চীৎকার করে বললো, “হে যাত্রীদল! তোমরা চোর৷” সম্ভবত পেয়ালা রেখে দেবার কাজটা হযরত ইউসুফ (আ) নিজের ভাইয়ের সম্মতি নিয়ে তার জ্ঞাতসারেই করেছিলেন। আগের আয়াতে এ দিকে ইংগিত করা হয়েছে। হযরত ইউসুফ (আ) দীর্ঘকালীন বিচ্ছেদের পর জালেম বৈমাত্রের ভাইয়ের হাত থেকে নিজের সহোদর ভাইকে রক্ষা করতে চাচ্ছিলেন। ভাই নিজেও এ জালেমদের সাথে ফিরে না যেতে চেয়ে থাকবেন। হযরত ইউসুফের নিজের পরিচয় প্রকাশ না করে তাকে প্রকাশ্যে আটকে রাখা এবং তার মিসরে থেকে যাওয়া সম্ভব ছিল না। আর এ অবস্থায় এ পরিচয় প্রকাশ করাটা কল্যাণকর ছিল না। তাই বিন ইয়ামীনকে আটকে রাখার জন্য দু'ভাইয়ের মধ্যে এ পরামর্শ হয়ে থাকবে। যদিও এর মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য ভাইয়ের অপমান অনিবার্য ছিল, কারণ তার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ আনা হচ্ছিল, কিন্তু পরে উভয় ভাই মিলে আসল ব্যাপারটি জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিলেই এ কলংকের দাগ অতি সহজেই মুছে ফেলা যেতে পারবে।তারা পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলো, “ তোমাদের কি হারিয়ে গেছে ?” সরকারী কর্মচারী বললো, “আমরা বাদশাহার পানপাত্র পাচ্ছি না,” (এবং তাদের জমাদার বললো :) “যে ব্যক্তি তা এনে দেবে তার জন্য রয়েছে পুরস্কার এক উট বোঝাই মাল৷ আমি এর দায়িত্ব নিচ্ছি৷” এ ভাইয়েরা বললো, “আল্লাহর কসম! তোমরা খুব ভালোভাবেই জানো, আমরা এ দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে আসিনি এবং চুরি করার মতো লোক আমরা নই” তারা বললো, “আচ্ছা, যদি তোমাদের কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলে চোরের কি শাস্তি হবে ?” তারা জবাব দিল, “তার শাস্তি” যার মালপত্রের মধ্যে ঐ জিনিস পাওয়া যাবে তার শাস্তি হিসেবে তাকেই রেখে দেয়া হবে৷ আমাদের এখানে তো এটাই এ ধরনের জালেমদের শাস্তির পদ্ধতি৷” উল্লেখ্য, এ ভাইয়েরা ছিল ইবরাহিমী পরিবারের সন্তান। কাজেই চুরির ব্যাপারে তারা যে আইনের কথা বলে তা ছিল ইবরাহিমী শরীয়াতের আইন। এ আইন অনুযায়ী চোরের শাস্তি ছিল, যে ব্যক্তির সম্পদ সে চুরি করেছে তাকে তার দাসত্ব করতে হবে।তখন ইউসুফ নিজের ভাইয়ের আগে তাদের থলের তল্লাশী শুরু করে দিল৷ তারপর নিজের ভাইয়ের থলের মধ্য থেকে হারানো জিনিস বের করে ফেললো৷ - এভাবে আমি নিজের কৌশলের মাধ্যমে ইউসুফকে সহায়তা করলাম৷ বাদশাহর দীন (অর্থাৎ মিসরের বাদশাহর আইন) অনুযায়ী নিজের ভাইক পাকড়াও করা তার পক্ষে সংগত ছিল না, তবে যদি আল্লাহই এমনটি চান৷যাকে চাই তার মর্তবা আমি বুলন্দ করে দেই আর একজন জ্ঞানবান এমন আছে যে প্রত্যেক জ্ঞানবানের চেয়ে জ্ঞানী৷ এ ভাইয়েরা বললো, “এ যদি চুরি করে থাকে তাহলে অবাক হবার কিছু নেই, কারণ এর আগে এর ভাইও (ইউসুফ) চুরি করেছিল৷” ইউসুফ তাদের একথা শুনে আতস্থ করে ফেললো, সত্য তাদের কাছে প্রকাশ করলো না শুধুমাত্র (মনে মনে) এতটুকু বলে থেমে গেলো, “বড়ই বদ তোমরা (আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার ওপর এই যে দোষারোপ তোমরা করছো সে সম্পর্কে আল্লাহ প্রকৃত সত্য ভালোভাবে অবগত৷” তারা বললো, “হে ক্ষমাতাসীন সরদার (আযীয)! এর বাপ অত্যন্ত বৃদ্ধ, এর জায়গায় আপনি আমাদের কাউকে রেখে দিন৷ আমরা আপনাকে বড়ই সদাচারী ব্যক্তি হিসেবে পেয়েছি৷” ইউসুফ বললেন, “আল্লাহর পানাহ! অন্য কাউকে আমরা কেমন করে রাখতে পারি ? যার কাছে আমরা নিজেদের জিনিস পেয়েছি তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য কাউকে রাখলে আমরা জালেম হয়ে যাবো৷” যখন তারা ইউসুফের কাছ থেকে নিরাশ হয়ে গেলো তখন একান্তে পরামর্শ করতে লাগলো৷ তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বয়সে বড় ছিল সে বললো : “তোমরা কি জান না, তোমাদের বাপ তোমাদের কাছ থেকে আল্লাহর নামে কি অংগীকার নিয়েছেন এবং ইতিপূর্বে ইউসুফের ব্যাপারে তোমরা যেসব বাড়াবাড়ি করেছো তাও তোমরা জানো৷ এখন আমি তো এখান থেকে কখনোই যাবো না যে পর্যন্ত না আমার বাপ আমাকে অনুমতি দেন অথবা আল্লাহ আমার ব্যাপারে কোন ফায়সালা করে দেন, কেননা তিনি সবচেয়ে ভালো ফায়সালাকারী৷ তোমরা তোমাদের বাপের কাছে ফিরে গিয়ে বলো, “আব্বাজান, আপনার ছেলে চুরি করেছে, আমরা তাকে চুরি করতে দেখিনি, যতটুকু আমরা জেনেছি শুধু ততটুকুই বর্ণনা করছি এবং অদৃশ্যেরই রক্ষণাবেক্ষণ করা তো আমাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না৷ আমরা যে পল্লীতে ছিলাম সেখানকার লোকজনদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখুন এবং যে কাফেলার সাথে আমরা ছিলাম তাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, আমরা যা বলছি৷” ইয়াকূব এ কাহিনী শুনে বললো, “আসলে তোমাদের মন তোমাদের জন্য আরো একটি বড় ঘটনাকে সহজ করে দিয়েছে৷ ঠিক আছে, এ ব্যাপারেও আমি সবর করবো এবং ভালো করেই করবো৷ হয়তো আল্লাহ এদের সবাইকে এনে আমার সাথে মিলিয়ে দেবেন৷ তিনি সবকিছু জানেন এবং তিনি জ্ঞানের ভিত্তিতে সমস্ত কাজ করেন৷” তারপর সে তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বসে গেলো এবং বলতে লাগলো, “হায় ইউসুফ”- সে মনে মনে দুঃখে ও শোকে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছিল এবং তার চোখগুলো সাদা হয়ে গিয়েছিল, ছেলেরা বললো, “আল্লাহর দোহাই! আপনি তো শুধু ইউসুফের কথাই স্মরণ করে যাচ্ছেন৷ অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, তার শোকে আপনি নিজেকে দিশেহারা করে ফেলবেন অথবা নিজের প্রাণ সংহার করবেন৷” সে বললো, “আমি আমার পেরেশানি এবং আমার দুঃখের ফরিয়াদ আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে করছি না৷ আর আল্লাহর ব্যাপারে আমি যতটুকু জানি তোমরা ততটুকু জানো না৷ হে আমার ছেলেরা! তোমরা যাও এবং ইউসুফ ও তার ভাইয়ের ব্যাপারে কিছু অনুসন্ধান চালাও৷ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না৷ তাঁর রহমত থেকে তো একমাত্র কাফেররাই নিরাশ হয়৷” যখন তারা মিসরে গিয়ে ইউসুফের সামনে হাযির হলো তখন আরয করলো, “হে পরাক্রান্ত শাসক! আমরা ও আমাদের পরিবার পরিজন কঠিন বিপদের মুখোমুখি হয়েছি এবং আমরা মাত্র সামান্য পুঁজি নিয়ে এসেছি৷ আপনি আমাদের পূর্ণমাত্রায় শস্য দিয়ে দিন এবং আমাদেরকে দান করুন, আল্লাহ দানকারীদেরকে প্রতিদান দেন৷” (একথা শুনে ইউসুফ আর চুপ থাকতে পারলো না) সে বললো, “তোমরা কি জানো, তোমরা ইউসুফ ও তার ভাইয়ের সাথে কি ব্যবহার করেছিলে, যখন তোমরা অজ্ঞ ছিলে ?” তারা চমকে উঠে বললো, “হায় তুমিই ইউসুফ নাকি ?” সে বললো, “হাঁ, আমি ইউসুফ এবং এই আমার সহোদর৷ আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন৷ আসলে সেউ যদি তাকওয়া ও ছবর অবলম্বন করে তাহলে আল্লাহর কাছে এ ধরণের সৎলোকদের কর্মফল নষ্ট হয়ে যায় না৷” তারা বললো, “আল্লাহর কসম, আল্লাহ তোমাকে আমাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং যথার্থই আমরা অপরাধী ছিলাম৷” সে জবাব দিল, “আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই৷ আল্লাহ তোমাদের মাফ করে দিন৷ তিনি সবার প্রতি অনুগ্রহকারী৷ যাও, আমার এ জামাটি নিয়ে যাও এবং এটি আমার পিতার চেহারার ওপর রেখো, তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন৷ আর তোমাদের সমস্ত পরিবার পরিজনকে আমার কাছে নিয়ে এসো৷” কাফেলাটি যখন (মিসর থেকে) রওয়ানা দিল তখন তাদের বাপ (কেনানে) বললো, “আমি ইউসুফের গন্ধ পাচ্ছি, তোমরা যেন আমাকে একথা বলো না যে, বুড়ো বয়সে আমার বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়েছে৷” ঘরের লোকরো বললো, “আল্লাহর কসম, আপনি এখনো নিজের সেই পুরাতন পাগলামি নিয়েই আছেন৷”তারপর যখন সুখবর বহনকারী এলো তখন সে ইউসুফের জামা ইয়াকূবের চেহারার ওপর রাখলো এবং অকস্মাত তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে এলো৷ তখন সে বললো, “আমি না তোমাদের বলেছিলাম, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন সব কথা জানি যা তোমরা জানো না ?” সবাই বলে উঠলো, “আব্বাজান৷ আপনি আমাদের গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করুন, সত্যিই আমরা অপরাধী ছিলাম৷” তিনি বললেন, “আমি আমার রবের কাছে তোমাদের মাগফেরাতের জন্য আবেদন জানাবো, তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়৷” তারপর যখন তারা ইউসুফের কাছে পৌঁছুলো তখন সে নিজের বাপ-মাকে নিজের কাছে বসালো এবং (নিজের সমগ্র পরিবার পরিজনকে) বললো, “চলো, এবার শহরে চলো, আল্লাহ চাহেতো শান্তি ও নিরপত্তার মধ্যে বসবাস করবে৷” (শহরে প্রবেশ করার পর) সে নিজের বাপ-মাকে উঠিয়ে নিজের পাশে সিংহাসনে বসালো এবং সবাই তার সামনে স্বতস্ফূর্তভাবে সিজদায় ঝুঁকে পড়লো৷ ইউসুফ বললো, “আব্বাজান! আমি ইতিপুর্বে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম এ হচ্ছে তার তা’বীর৷ আমার রব তাকে সত্য পরিণত করেছেন ৷ আমার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ হিসেবে তিনি আমাকে কারাগার থেকে বের করেছেন এবং আপনাদেরকে মরু অঞ্চল থেকে এনে আমার সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন৷ আসলে আমার রব অননুভূত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করেন৷ নিসন্দেহে তিনি সবকিছু জানেন ও সুগভীর প্রজ্ঞার অধিকারী৷ হে আমার রব! তুমি আমাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করেছো এবং আমাকে কথার গভীরে প্রবেশ করা শিখিয়েছো৷ হে আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা! দুনিয়ায় ও আখেরাতে তুমিই আমার অভিভাবক৷ ইসলামের ওপর আমাকে মৃত্যু দান করো এবং পরিণামে আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তরভূক্ত করো৷”