বনী ইসরাইল জাতির ঘটনা
বনী ইসরাইল জাতির উদ্ধার পাওয়ার ঘটনাটি ছিল স্পষ্ট মুজেযা এবং আল্লাহর অলৌকিক কাজের দৃষ্টান্ত। আল্লাহর নির্দেশে হযরত মূসা (আঃ) তার জাতিকে মিশর থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু যখন হযরত মূসা ( আঃ) নীল নদের কাছাকাছি পৌঁছলেন তখন বুঝতে পারলেন যে, ফেরাউন ও তার বাহিনী তাদের পিছু ধাওয়া করছে। প্রচণ্ড উদ্বেগ আর আতঙ্কে বনী ইসরাইল গোত্র কাঁপতে থাকল। তখন আল্লাহর আদেশে হযরত মূসা (আঃ) তার হাতের লাঠিখানা দিয়ে সাগরে আঘাত করলেন। সাগরের পানি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল এবং নীল নদ অতিক্রমের জন্য একটি পথ সৃষ্টি হলো। ফেরাউনের বাহিনী নীল নদের মধ্যেই তাদের পিছু ধাওয়া করল। কিন্তু যখন তারা মাঝামাঝি পৌঁছল তখন নীল নদের পানি একত্রিত হল এবং ফেরাউন বাহিনী ধ্বংস হয়ে গেল। বনী ইসরাইল জাতি নিশ্চিত মৃত্যু থেকে রক্ষা পেল। তারা আল্লাহর মুজেযা দেখলো ও স্বচক্ষে দুশমনদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ করলো। এর চেয়ে বড় দয়া ও নেয়ামত আর কি হতে পারে ?
ফেরাউনের অত্যাচার থেকে বনী ইসরাইল জাতি উদ্ধার পাবার পর ৪০ দিনের জন্য হযরত মূসা (আঃ)কে তুর পাহাড়ে যেতে হলো। সেখানে তিনি গেলেন তওরাতের বাণী গ্রহণের জন্য। কিন্তু এই অল্প সময়েই বনী ইসরাইল জাতির জন্য এক বড় পরীক্ষা আসল। সামেরী নামের এক অতি ধূর্ত ব্যক্তি মানুষের সোনা-দানা দিয়ে একটি গরুর বাছুরের প্রতিকৃতি তৈরী করল। মুর্তিটি থেকে গরুর ডাক ভেসে আসত এবং জনগণ অবাক হয়ে যেত। সামেরী তখন জনগণকে স্বর্ণের তৈরী অদ্ভুত ওই মুর্তির উপাসনার দিকে আহ্বান জানায়। বেশীরভাগ মানুষ সামেরীর দলে যোগ দিল এবং বাছুর পূজা শুরু করল। এ কাজের মাধ্যমে তারা নিজের ওপর যেমন জুলুম করলো তেমনি সুযোগ্য নেতা ও নবী হযরত মূসা (আঃ)এর ওপর জুলুম করলো। অথচ হযরত মূসা (আঃ) তাদেরকে ফেরাউনের হাত থেকে রক্ষার জন্য কি কষ্টই না সহ্য করেছিলেন। অবশ্য তুর পাহাড় থেকে হযরত মূসা ফিরে আসার পর জনগণ তাদের অন্যায় বুঝতে পারলো। আল্লাহ তখন তাদের এই শিরকের অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন।মহান আল্লাহ ফেরাউনের কবল থেকে বনী ইসরাইলকে রক্ষা করার পর তাদেরকে ফিলিস্তিনে যাবার নিদের্শ দেন। কিন্তু সেখানে অত্যাচারীদের শাসন ব্যবস্থা বিরাজ করছে এই অজুহাত দেখিয়ে ইহুদীরা সেখানে যাওয়া থেকে বিরত থাকে। ফলে আল্লাহর ক্রোধ তাদেরকে ঘিরে ফেলল। অর্থাৎ তাদের ওপর আল্লাহর শাস্তি নেমে এল এবং প্রায় ৪০ বছর ধরে তারা সিনাই উপত্যকায় ভবঘুরের মত ও অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়াল। এই দীর্ঘ সময়ে অবশ্য তাদের অনেকে নিজেদের কর্মকাণ্ডের জন্য অনুতপ্ত হলো এবং মহান আল্লাহ পুনরায় তাদের ওপর দয়া করলেন। আর ওই দয়া ও অনুগ্রহের কথাই এ আয়াতে বলা হয়েছে। ওই তপ্ত ও শুষ্ক মরুভূমির ওপর ছায়াদান ছাড়াও আল্লাহ তাদেরকে সেখানে দু'ধরনের খাবার দিচ্ছিলেন। প্রথম ধরনের খাবার ছিল মধু জাতীয় এক ধরনের খাবার যা গাছের রস থেকে তৈরি হতো। এ খাবারকে বলা হতো মান্না। আর সালওয়া অর্থাৎ দ্বিতীয় ধরনের খাবার ছিল কবুতর জাতীয় এক ধরনের পাখি। যদিও হযরত মূসা (আঃ) বনী ইসরাইলের কাছে প্রেরিত নবী বা পয়গম্বর ছিলেন এবং তার মূল দায়িত্ব ছিল আল্লাহর বাণী তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঐশী পথ-প্রদর্শকরা মানুষের পার্থিব কল্যাণ ও পার্থিব সমস্যা নিয়েও চিন্তা করেন। তাই হযরত মূসা (আঃ) তার জাতির জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। আল্লাহ হযরত মূসা (আঃ)-এর দোয়া কবুল করেন এবং অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে তাদেরকে পানি দান করেন। এজন্যে তিনি হযরত মূসা (আঃ)কে তার সেই লাঠি দিয়ে পাথরে আঘাত করতে বলেন,যে লাঠির আঘাতে তিনি নীল দরিয়ায় শুকনো পথ সৃষ্টি করেছিলেন। এভাবে আল্লাহ তাদের এটাও বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তার নবী যেকোন কাজ করতে সক্ষম। বনী ইসরাইল বা ইসরাইলের বংশধরদের মধ্যে ১২টি গোত্র বা গোষ্ঠী ছিল। আল্লাহর ইচ্ছায় তাদের জন্য ১২টি ঝর্ণা বা প্রস্রবন সৃষ্টি হলো, যাতে প্রত্যেক গোত্র আলাদাভাবে পানি পেতে পারে এবং পানির সংকট দেখা না দেয়। এভাবে আল্লাহ একদিকে মান্না ও সালওয়া খাবার পাঠিয়ে এবং অন্যদিকে যথেষ্ট পানির ব্যবস্থা করে ইহুদী জাতির কল্যাণের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন যাতে তারা পাপাচার, নৈরাজ্য ও হঠকারিতা থেকে দূরে থাকতে পারে।এখানে বনি ইসরাইলীদের আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনাটি হল- মহান আল্লাহ তাদের জন্য শনিবারকে বিশ্রামের দিন ঘোষণা করেছিলেন। অর্থাৎ শনিবারে কাজ-কর্ম নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু সমুদ্র উপকূলে বসবাসকারী একদল ইহুদী এক ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে শনিবারে মাছ ধরতো। তারা সাগরের প্রান্তে এক ধরনের ফাঁদ বা গর্ত তৈরি করতো এবং ওইসব গর্তে মাছ প্রবেশ করার পর গর্তের মুখ বা প্রবেশপথ বন্ধ করে দিত এবং পরের দিন অর্থাৎ রোববারে ওইসব মাছ ধরতো। আর এভাবে তারা আল্লাহর নির্দেশকে অবজ্ঞা করেছিল। আল্লাহও তার বিধানকে অমান্য করা ও ঐশি বিধি-বিধানকে অবজ্ঞা করার শাস্তি হিসাবে তাদের চেহারাকে বিকৃত করে দেন এবং তাদেরকে বানরে রূপান্তরিত করেন যাতে অন্যরাও এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। যদিও পশুরা আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত নয়, কিন্তু মানুষকে পশুতে রূপান্তর করার মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে নিজের দরবার ও অনুগ্রহ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন।