মহান আল্লাহ তায়া’লা ইরশাদ করেন

الذين يقيمون الصلوة ومما رزقنهم ينفقون- اولئك هم المومنون حقا- لهم درجت عند ربهم ومغفرة ورزق كريم-

‘‘যারা নামায কায়েম করে এবং আমার দেয়া রিযিক থেকে ব্যয় করে। তারা হল সত্যিকার ঈমানদার। তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মান জনক রিযিক। [ সূরা আনফাল-৩-৪]

Pages

সুরা ইয়াসিন এর আলোকে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও কর্তব্য

ইয়াসিন পবিত্র কুরআনের ৩৬তম সুরা যা অবতীর্ণ হয়েছে পবিত্র মক্কাতে। এই সুরায় রয়েছে পাঁচটি করুকূ ও ৮৩টি আয়াত। ইয়াসিন শব্দটি হুরূফ আল-মুকাত্তা’আত। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন সুরার প্রথমে এ ধরণের বিচ্ছিন্ন অক্ষরসমূহ রয়েছে যার প্রকৃত অর্থ অন্তর্ণিহিত তাৎপর্য কেবলমাত্র আল্লাহ পাক জানেন। মহান স্রষ্টা আল্লাহ তাআলা সব জ্ঞানের নির্যাস বিজ্ঞানময় আল কুরআন নাযিল করেছেন তাঁর সর্বশেষ রাসুল সা. এর উপর। যাতে তাঁর প্রিয় বান্দারা সতর্ক হতে পারে, সঠিক পথ পেতে পারে এবং জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য, গন্তব্য ও কর্তব্য সম্পর্কে জেনে সে অনুযায়ী নিজেকে পরিচালিত করতে পারে।
আল কুরআনের সুরা ইয়াসিনে মানুষের চূড়ান্ত সাফল্যের বিষয়ে সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। হয় সে এই দিক নির্দেশনা অনুসরণ করে চিরস্থায়ী পরম শান্তিময় জান্নাতে তার দয়াময় প্রভুর ‘সালাম’ লাভ করবে। অথবা এর বিপরীতে কৃত অপরাধের শাস্তি স্বরূপ দয়াময় প্রভুর ‘সালাম’ লাভকারীদের থেকে পৃথক হয়ে অপরাধী হিসেবে নিক্ষিপ্ত হবে চিরস্থায়ী কঠিন শান্তির দুঃসহ যন্ত্রণাময় জাহান্নামের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুন্ডে।
মহান স্রষ্টা তাঁর বান্দাদের চূড়ান্ত গন্তব্য হিসেবে এ দু’টো স্থানকে নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং এর যে কোনো একটিকে গ্রহণ করার স্বাধীনতা, এখতিয়ার মানুষকে দিয়েছেন। তবে “তাদের অধিকাংশের সম্পর্কেই স্থির সিদ্ধান্ত রয়েছে যে, তারা ঈমান আনবে না।” [সুরা ইয়াসিন:৭] এক্ষেত্রে রাসুল সা. এবং তাঁর উম্মতদের দায়িত্বের ব্যাপারে আল্লাহ পাক সুরা ইয়াসিনে পরিস্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন- “আর (আল্লাহর পাকের মহান বাণী) সুস্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়া ব্যতীত আমাদের উপর আর কোনো দায়িত্ব নাই।” [সুরা ইয়াসিন : ১৭]
বিতাড়িত অভিশপ্ত শয়তানের সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা হচ্ছে মানুষকে বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট করে আল্লাহর ইবাদত থেকে দূরে সরিয়ে রেখে স্বীয় উপাসনায় আকৃষ্টের মাধ্যমে জাহান্নামের পথে তাকে ধাবিত করা। মানুষের প্রকাশ্য শত্র“ অবাধ্য, দাম্ভিক শয়তানের উপাসনা হচ্ছে চরমতম অপরাধ যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি সীমাহীন যন্ত্রণাদায়ক জাহান্নাম। প্রতারক শয়তানের ধোঁকা থেকে মানুষকে রক্ষা করে সঠিক পথ দেখানোর জন্যে মহান স্রষ্টা যুগে যুগে নবী রাসুল পাঠিয়েছেন। আল্লাহ পাক এ জন্যে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, “অনুকরণ কর তাঁহাদের যাঁহারা তোমাদের নিকট কোনো বিনিময় চাহেন না। এবং তাঁহারা সঠিক পথপ্রাপ্ত।” [সুরা ইয়াসিন : ২১] কিন্তু শয়তানের পদলেহনকারী পাপিষ্ঠ দুর্বৃত্তদের দ্বারা কেবল নবী রাসুলগণ নন তাঁদের অনুসারীরাও নির্যাতিত হয়েছেন, শাহাদৎ লাভ করেছেন। আর পরিণতিতে শাহাদাতের মর্যাদা লাভকারীরা মহান প্রভুর প্রশান্তিময় জান্নাত লাভে ধন্য ও পরিতৃপ্ত হয়েছেন। সেখানে আক্ষেপ শুধুমাত্র এটুকু যে, দয়াময় মেহেরবান প্রভুর এই অসীম ক্ষমা এবং অকল্পনীয় মর্যাদা, সম্মান, সৌভাগ্যের কথা যদি তাঁর সম্প্রদায়ের সবাই জানতে পারতো। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, তাকে বলা হলো জান্নাতো প্রবেশ কর। সে বলল, ‘হায়! আমার কওম যদি জানতে পারতো! [সুরা ইয়াসিন : ২৬]
ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে মানুষের আসল গন্তব্য চিরস্থায়ী ঠিকানায় পৌঁছার লক্ষ্যে মহান প্রভুর সামনে সবাইকে অবশ্যই দাড়াতে হবে। সুরা ইয়াসিনে কিয়ামতের পরিস্কার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। “আর শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে তখনই তারা ছুটে আসবে তাদের প্রতিপালকের দিকে।” [সুরা ইয়াসিন : ৫১] কিয়ামতের প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে আল্লাহ তা’আলা তাঁর কিতাবসমূহে এবং নবী রাসুলদের মাধ্যমে বারবার তুলে ধরে তাঁর বান্দাদের সঠিক জ্ঞান দান করেছেন। এই কিয়ামত যে অবশ্যই সংঘঠিত হবে সে খবর প্রথম মানব ও নবী হযরত আদম আ. থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী হযরত মোহাম্মাদ সা. পর্যন্ত এক লাখ বা দু’ লাখ চব্বিশ হাজার নবী রাসুলের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মানুষকে জানিয়েছেন। নবী রাসুলগণ প্রত্যেকেই ছিলেন পরম সত্যবাদী, সম্পূর্ণ নিঃস্বর্থ এবং তাদের সময়ের সর্বোত্তম মানব। “তারা বলবে, হায়! দুর্ভোগ আমাদের! কে আমাদেরকে আমাদের নিদ্রাস্থল হতে উঠালো? (তাদের বলা হবে) এটা তো তা যার প্রতিশ্র“তি পরমকরুণাময় করেছিলেন এবং রাসুলগণ সত্যই বলেছিলেন।” [সুরা ইয়াসিন : ৫২]
মহাবিচারক আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা কিয়ামতের দিন তাঁর বান্দাদের প্রতি সুনিশ্চিতভাবে সুবিচার করবেন। দুনিয়াতে যে যেরকম আমল করেছে কিয়ামতের দিন তার প্রতিফল সে অনুযায়ী দেয়া হবে। কিয়ামতে ন্যায়বিচাররের বিষয়ে আল্লাহর সুস্পষ্ট ঘোষণা- “আজ কারো প্রতি কোনো যুলুম করা হবে না এবং তোমরা যা আমল করছিলে কেবল তারই প্রতিফল দেয়া হবে।” [সুরা ইয়াসিন : ৫৪]
মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে সামান্য শুক্রকীট থেকে। জোড়ায় জোড়ায় সব প্রাণীর সৃষ্টি, আসমান ও যমীনের সৃষ্টি, চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্রের নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণ, দিন ও রাতের আবর্তন, দীর্ঘ জীবন লাভের পর শারীরিক আকৃতির পরিবর্তন, মৃতকে পুণর্জীবিত করা, নৌযানের চলাচল, নির্জীব পৃথিবীকে সজীব করা, জান্নাত জাহান্নাম সৃষ্টি, শিংগায় ফুৎকারের মাধ্যমে কিয়ামতের উদ্ভব, আখিরাতে মানুষের প্রভুর পানে ছুটে চলা ও মুখ বন্ধ হয়ে হাত পা’র কথা বলা, সবুজ বৃক্ষ হতে আগুনের সৃষ্টি, ‘হও’ শব্দটি বলা মাত্র বান্তুবে প্রকৃতপক্ষে তা হয়ে যাওয়া সব কিছুই মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলার অপার কুদরত। এই কুদরতগুলোর অপরূপ ও অতুলনীয় বর্ণনা উপমাসহ অথবা উপমা ছাড়াই সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে সুরা ইয়াসিনে।
আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয়তম রাসুল সা.-এর উপর নাযিল করেছেন সর্বোচ্চ সাহিত্য ও কাব্য গুণসম্পন্ন জ্ঞানগর্ভ এই কুরআন। তবে তাঁকে তিনি কবিতা শিক্ষা দেননি। এটা তাঁর জন্যে শোভনীয়ও নয়। আল কুরআন হচ্ছে সর্বোত্তম উপদেশ ও সুস্পষ্ট সতর্কবাণী। এই কুরআন দুনিয়াতে জীবিতদের সতর্ক করে আর আখিরাতে কাফিরদের বিরুদ্ধে আল্লাহর ওয়াদার সত্যতার সক্ষ্য দিবে। [সুরা ইয়াসিন : ৩৯] প্রকৃতপক্ষে একনিষ্ঠভাবে ও একাগ্রচিত্তে দয়াময় প্রভু আল্লাহর ইবাদত করাই হচ্ছে একমাত্র সঠিক পথ। [সুরা ইয়াসিন : ৬১] কাজেই বৃদ্ধিমানের কথা হচ্ছে সুরা ইয়াসিনের ২২নং আয়াতের আলোকে, “আমার কি যুক্তি আছে যে, (আল্লাহ) যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং যাঁর নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে আমি তাঁর ইবাদত করবো না?”