মহান আল্লাহ তায়া’লা ইরশাদ করেন

الذين يقيمون الصلوة ومما رزقنهم ينفقون- اولئك هم المومنون حقا- لهم درجت عند ربهم ومغفرة ورزق كريم-

‘‘যারা নামায কায়েম করে এবং আমার দেয়া রিযিক থেকে ব্যয় করে। তারা হল সত্যিকার ঈমানদার। তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মান জনক রিযিক। [ সূরা আনফাল-৩-৪]

Pages

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ


 রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ থেকে আমরা বহু দূরে। অথচ সিরাতুন্নবীই হলো এই উম্মতের একমাত্র আদর্শ। যে আদর্শ হলো পরশপাথর, যার পরশে মাটি হয় সোনা। যে আদর্শ ধারণ করে সাধারণ মানুষ হয় সর্বোৎকৃষ্ট মানব। যে আদর্শ চর্চার যুগ হয় ইতিহাসের সোনালি যুগ। আর সত্যিকারের মানুষ হওয়ার জন্য এই আদর্শের কোনো বিকল্প নেই। অতএব নির্দিষ্ট দিন, মাসে এত আয়োজনের গতানুগতিকতা থেকে বের হয়ে নবীর আদর্শকে নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করাই সময়ের দাবি।
মানব জীবনের সবক্ষেত্রেই আছে নবীর আদর্শ। প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ থেকে নিয়ে রাষ্ট্রপরিচালনার গুরুদায়িত্ব পালনেও রয়েছে তার আদর্শ। যারা এ আদর্শ ধারণ করবে, নিজের জীবনে ও কাজে-কর্মে তা বাস্তবায়ন করবে, তারাই হবে আদর্শবান, তারাই হবে সোনার মানুষ। পরপ্রজšে§র জন্য তারা হবে আদর্শ পূর্বসূরি। এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই বনি ইসরাইল বাহাত্তরটি দলে বিভক্ত হয়েছিল আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে তেহাত্তরটি দলে। তাদের একটি ছাড়া সবগুলোই হবে জাহান্নামি। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! সা. সে দল কোনটি? তিনি ইরশাদ করলেন, যার ওপর আমি ও আমার সাহাবিরা প্রতিষ্ঠিত। [জামে তিরমিজি]
অতএব আমাদের উচিত জীবনের সব অঙ্গনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ অনুসরণ করা। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফিক দান করুন। সিরাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আখলাক ও চরিত্র। উম্মুল মুমিনীন আয়েশাকে রা. রাসুলের আখলাক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, কুরআন মাজিদই হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আখলাক। অর্থাৎ রাসুলের গোটা জীবন ছিল কুরআন মাজিদের ব্যবহারিক তাফসির। এ প্রসঙ্গে খোদ কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত। [সুরা : কলম]
নিম্নে উত্তম চরিত্রের কয়েকটি দিক সক্ষেপে তুলে ধরা হলো :

১. তাওয়াক্কুল তথা আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের মধ্যে সত্তর হাজার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে, যারা মন্ত্র-তন্ত্র ব্যবহার করে না, কুলক্ষণ গ্রহণ করে না এবং যারা তাদের প্রতিপালকের ওপর ভরসা রাখে। [সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম]   হযরত ওমর রা. বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে,  তোমরা যদি আল্লাহর ওপর যথাযথ ভরসা কর তাহলে তিনি তোমাদের পাখিদের মতো রিজিক দান করবেন। পাখিরা সকালে খালি পেটে বের হয় অথচ সন্ধ্যায় ফিরে আসে উদরপূর্তি হয়ে। [জামে তিরমিজি, সুনানে ইবনে মাজাহ]

২. ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মুমিনের এই বিষয়টি খুবই আশ্চর্যজনক যে, সব অবস্থায়ই তার জন্য কল্যাণকর। আর এটি শুধু মুমিনেরই  বৈশিষ্ট্য। সুখ ও আনন্দের কিছু হলে সে শোকর আদায় করে। ফলে এটি তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর দুঃখ-কষ্ট এলে সে সবর ও ধৈর্য ধারণ করে, এটাও তার জন্য মঙ্গলজনক। [সহিহ মুসলিম]

৩. অল্পতে তুষ্ট থাকা : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সে ব্যক্তি সফলকাম যে ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং তাকে পরিমিত রিজিক প্রদান করা হয়েছে। আর আল্লাহ তাআলার দেয়া রিজিকে তাকে তুষ্ট করে দিয়েছেন। [সহিহ মুসলিম]

৪. অঙ্গীকার রক্ষা করা : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি: ক) কথা বললে মিথ্যা বলা খ) অঙ্গীকার করলে তা রক্ষা না করা ও গ) আমানত রাখলে খেয়ানত করা। [সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম]

৫. বিনয় : উমর রা. মিম্বরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন, হে লোকসব! তোমরা বিনয় অবলম্বন কর। কেননা, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য বিনয় অবলম্বন করবে আল্লাহ তাআলা তার মর্যাদাও বুলন্দ করে দেবেন।

৬. সত্যবাদিতা : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা সত্যবাদিতা অবলম্বন কর। কেননা, সত্যবাদিতা পুণ্যের দিকে নিয়ে যায়। [সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম]

৭. লজ্জাশীলতা : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, প্রতিটি ধর্মেরই একটি বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্য থাকে। আর ইসলামের বৈশিষ্ট্য হলো লজ্জাশীলতা। [সুনানে ইবনে মাজাহ]

৮. নম্রতা : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা কোমল আর তিনি কোমলতা পছন্দ করেন। [সহিহ মুসলিম] অন্য হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি নম্রতা থেকে বঞ্চিত  সে অনেক কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত। [সহিহ মুসলিম]

৯. অন্যের প্রতি দয়া : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি মানুষের ওপর দয়া করে না আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না। [সহিহ বুখারি]

১০. বদান্যতা ও দানশীলতা : হজরত জাবের রা. বলেন, কখনও এমন হয়নি যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কিছু চাওয়া হয়েছে আর তিনি ‘না’ বলেছেন। [সহিহ বুখারি]

১১. পরোপকার : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সব সৃষ্টিই আল্লাহর পোষ্য। সব সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে পছন্দীয় ওই ব্যক্তি যে আল্লাহর পোষ্যের সঙ্গে অনুগ্রহ প্রদর্শন করে। [বায়হাকি]
চরিত্র গঠনে মহানবী সা. -এর দিক নির্দেশনা
মানব জীবনে আখলাকের গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ তার মনে প্রোথিত মূল্যবোধ ও গুণাবলির আলোকেই সম্পাদিত হয়। দার্শনিক ঈমাম গাজ্জালীর মতে  যেমন গুণাবলি মানব মনে জাগরুক থাকে তারই প্রতিফলন তার বাহ্যিক কাজ-কর্মে প্রকাশিত হয়। এর আলোকে  বলা যায় মানুষের কোন কাজই তার মূল চিন্তা-চেতনা বহির্ভূত নয়।
এ জন্যই যুগে যুগে সংস্কারকরা মানুষের সংশোধন ও পবিত্র জীবন যাপনের পন্থা হিসেবে তাদের আত্মার পরিশুদ্ধি ও মূল্যবোধের জ্ঞান প্রথমেই শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতেন। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের উন্নতি-অবনতি, উত্থান-পতন, মান-সম্মান ইত্যাদি সব কিছুই তাদের মানসিক বিকাশ ও মূল্যবোধ জাগ্রত করার ওপরই নির্ভর করে। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে ইরশাদ হচ্ছে: “আল্লাহ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না যে পর্যন্ত না তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনে এগিয়ে আসে”। [সুরা আর-রা’দ, ১১]
চারিত্রিক উন্নতি বিকাশকে ইসলাম অত্যধিক গুরুত্বারোপ করে থাকে, এমনকি তা ইসলামী শিক্ষার অন্যতম একটি কোর্স হিসেবে পরিগণিত করা হয়। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ হতে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ তথা সমগ্র মানব সমাজের চারিত্রিক উন্নয়নে প্রচুর নির্দেশনা বিদ্যমান। মূলত মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য এ চরিত্রের আলোকেই হয়ে থাকে। আখলাকের মাধ্যমেই মানুষ মনুষ্যত্বের চূড়ান্ত মানে উন্নীত হতে পারে। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন-বিধান। এ বিধানের পরিপূর্ণতার জন্য তাতে উন্নত চরিত্রের বিধান থাকা আবশ্যক। তাই ইসলামে ‘আখলাকুল হাসানাহ’্ তথা উন্নত চরিত্রের স্থান অনেক ঊর্ধ্বে। নিম্নের আলোচনায় তার প্রতি ইঈিত প্রদান করা হচ্ছে।
পৃথিবীতে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের নিমিত্তে আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রাসুলদের প্রেরণ করেছেন। আমাদের প্রিয়নবী সা. কে প্রেরণের  অন্যতম কারণ সচ্চরিত্রের বিকাশ সাধন। নবী করীম সা. বলেন: “আমাকে সচ্চরিত্রের পূর্ণতা সাধনের নিমিত্তই প্রেরণ করা হয়েছে।”[   ] একদা জনৈক ব্যক্তি রাসুল সা. কে দীনের সংজ্ঞা জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বলেন: “উত্তম চরিত্র”। এ কথা দ্বারা বুঝা যায় সচ্চরিত্র বা উত্তম চরিত্র দীনের অন্যতম রুকন, যা ব্যতীত দীনের অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। যেমন হজ্ব সম্পর্কে রাসূলের বাণী: “হজ্বের গুরুত্বপূর্ণ একটি রুকন হচ্ছে আরাফায় অবস্থান করা” যা ব্যতীত হজ্ব আদায় হয় না, তেমনি ভাবে সচ্চরিত্র ব্যতীত দ্বীনও পরিপূর্ণ হয় না।
কেয়ামতে আমলনামা ভারী হওয়া: এ প্রসঙ্গে রসূলের বাণী: ‘কেয়ামতের মাঠে হিসাব-নিকাশের সময় ’আল্লাহ ভীতি ও সচ্চরিত্রের গুণ’ মু’মিনের আমলনামাকে ভারী করবে।’
মু’মিনদের মানগত বিন্যাস: মু’মিনরা সবাই ঈমানদার হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে গুণগত দিক থেকে পার্থক্য রয়েছে। একদা জনৈক ব্যক্তি রাসুল সা.কে উত্তম ঈমানদার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বলেন, “তাদের মধ্যে যে শ্রেষ্ঠ চরিত্রবান সেই উত্তম”। কেয়ামতে রসূলের নৈকট্য অর্জন করা: মু’মিনরা  কেয়ামতে রাসুল সা. এর ভালোবাসা ও নৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে সবাই এক রকম হবে না। এ প্রসঙ্গে রাসুল সা. বলেন:‘কেয়ামতের দিবস তোমাদের মধ্যে আমার নিকট বেশি পছন্দনীয় ও অবস্থানের ক্ষেত্রে অধিক নিকটবর্তী হবে তোমাদের মধ্যে উত্তম চরিত্রের লোকরাই’। পরকালে মুক্তির উপায়: ইসলামের অপরিহার্য ফরজ তথা নামায-রোযা পালন করা সত্ত্বেও পরকালে জাহান্নাম থেকে নাজাত ও জান্নাত লাভের জন্য আখলাক তথা উত্তম চরিত্রের কোন বিকল্প নেই। একদা এক ব্যক্তি রাসুল সা. কে নামাযী ও রোজাদার হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবেশীদের কষ্টদানকারিণী  জনৈকা মহিলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন :“তার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই, সে জাহান্নামী”। 
* রাসুল সা. এর আখলাক সম্পর্কে দোয়া: রাসুল সা. নিজে নিষ্পাপ হয়েও নিজের চরিত্র সুন্দর করার তৌফিক অর্জনের জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করতেন। যেমন তিনি দোয়ায় বলতেন: “আল্লাহ তুমি আমার গঠন-আকৃতি সুন্দর করেছ, আমার চরিত্রকেও সুন্দর করে দাও”। আল্লাহ কর্তৃক রাসুল সা. এর চরিত্রের প্রশংসা: পবিত্র কুরআনের বাণী :“আপনি মহান চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত”। আয়াতে মহান আল্লাহ কর্তৃক রাসুল সা. এর আখলাকের প্রশংসা করার মাধ্যমে ইসলামে এর অবস্থান সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে।
কুরআনে আখলাকের আয়াতের আধিক্য: পবিত্র কুরআনের প্রচুর আয়াতে আখলাকের বিবরণ ও চরিত্রবানদের প্রশংসার বাণী উদ্ধৃত হয়েছে, মাক্কী ও  মাদানী উভয় সুরাগুলোতে আখলাকের নির্দেশ বেশি থাকায় এর গুরুত্বেরও আধিক্য বুঝা যায় যা থেকে কোন মুসলিমের দূরে থাকা অসম্ভব।