মহান আল্লাহ তায়া’লা ইরশাদ করেন

الذين يقيمون الصلوة ومما رزقنهم ينفقون- اولئك هم المومنون حقا- لهم درجت عند ربهم ومغفرة ورزق كريم-

‘‘যারা নামায কায়েম করে এবং আমার দেয়া রিযিক থেকে ব্যয় করে। তারা হল সত্যিকার ঈমানদার। তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মান জনক রিযিক। [ সূরা আনফাল-৩-৪]

Pages

জান্নাতী এক সাহাবীর আমল

হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে বসা ছিলাম। তিনি এরশাদ করলেন, এখনই তোমাদের নিকট একজন বেহেশতী লোক আসবে। এমন সময় একজন আনসারী সাহাবি আসলেন, তাহার নাম হযরত সাদ বিন ওয়াক্কাস রা.। যার দাড়ি হতে অজুর পানির ফোটা টপকিয়ে পড়তেছিল এবং তিনি জুতা বাম হাতে নিয়ে রেখে ছিলেন। দ্বিতীয় দিনও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ কথাই বললেন এবং সেই আনসারি ঐ অবস্থাতেই আসলেন, যে অবস্থাতে আমরা প্রথমে দেখেছিলাম। তৃতীয় দিন আবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ কথাই বললেন এবং সেই আনসারি সাহাবি ঐ প্রথম অবস্থাতেই আসলেন। যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (মজলিস হইতে) উঠলেন, তখন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. সেই আনসারির পিছনে গেলেন এবং তাঁকে বললেন, আমার পিতার সাথে ঝগড়া হয়েছে। সে কারণে আমি কসম খেয়েছি যে, তিন দিন আমি বাড়িতে যাব না। যদি আপনি ভালো মনে করেন তবে আমাকে আপনার এখানে তিন দিন অবস্থান করতে দিন। তিনি বললেন, বেশ ভালো। হযরত আনাস রা. বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ রা. বর্ণনা করেন যে, আমি তার নিকট তিন রাত্র অতিবাহিত করেছি। আমি তাকে রাত্রে কোন ইবাদত করতে দেখিনি। তবে যখন রাত্রে তার চোখ খুলে যেত এবং বিছানার উপর পার্শ্ব বদলাতেন তখন আল্লাহ তাআলার যিকির করতেন ও আল্লাহু আকবার বলতেন। এইভাবে ফযরের নামাযের জন্য বিছানা  হতে উঠতেন। আরেকটি বিষয় এও ছিল যে, আমি তাঁর নিকট হতে ভাল ছাড়া অন্য কিছু শুনি নাই।
যখন তিন রাত্র অতিবাহিত হয়ে গেল এবং আমি তাঁর আমল আমার নিকট সাধারণ মনে হল। এবং আমি আশ্বর্যবোধ করতেছিলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জন্য এত বড় সুসংবাদ দিয়েছেন অথচ তার কোন খাস আমল তো নাই! তখন আমি তাকে বলিলাম, হে আল্লাহর বান্দা! আমার এবং আমার পিতার মধ্যে না কোন অসন্তুষ্টি হয়েছে এবং না  কোন বিচ্ছেদ হয়েছে। তবে ঘটনা এই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে (আপনার সম্পর্কে ) তিনবার এই এরশাদ করতে শুনেছিÑএখনই তোমাদের নিকট একজন বেহশতি লোক আসবে। অতঃপর তিনবারই আপনি আসছেন। তখন আমি ইচ্ছা করলাম যে, আমি আপনার এখানে থেকে আপনার বিশেষ আমল দেখব। যাতে (ঐ আমল গুলির ব্যাপারে) আপনার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলি। আমি আপনাকে  বেশি আমল করতে দেখি নাই। (এখন আপনি বলুন) আপনার এই বিশেষ আমল কোনটি যার কারণে আপনি এই মর্তবায় পৌঁছেছেন? যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনার সম্পর্কে এরশাদ করেছেন। ঐ অনুসারী বললেন, আমার কোন খাছ আমল তো নাই। এসব আমলই আছে যা তুমি দেখেছ। হযরত আব্দুল্লাহ রা. বলেন, আমি একথা শুনে রওনা দিলাম। যখন আমি ফিরে চললাম তখন তিনি আমাকে ডাকলেন এবং বললেন, আমার কাছে আরো দুটি আমল আছে। ১. আমি কারো গীবত করি না। ২. এবং আমি কাহার প্রতি হিংসা করি না। হযরত আব্দুল্লাহ রা. বলেন, এটাই সেই আমল, যার কারণে আপনি ঐ মর্তবায় পৌঁছেছেন। আর ইহা এমন আমল যা আমরা করতে পারি না।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ


 রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ থেকে আমরা বহু দূরে। অথচ সিরাতুন্নবীই হলো এই উম্মতের একমাত্র আদর্শ। যে আদর্শ হলো পরশপাথর, যার পরশে মাটি হয় সোনা। যে আদর্শ ধারণ করে সাধারণ মানুষ হয় সর্বোৎকৃষ্ট মানব। যে আদর্শ চর্চার যুগ হয় ইতিহাসের সোনালি যুগ। আর সত্যিকারের মানুষ হওয়ার জন্য এই আদর্শের কোনো বিকল্প নেই। অতএব নির্দিষ্ট দিন, মাসে এত আয়োজনের গতানুগতিকতা থেকে বের হয়ে নবীর আদর্শকে নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করাই সময়ের দাবি।
মানব জীবনের সবক্ষেত্রেই আছে নবীর আদর্শ। প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ থেকে নিয়ে রাষ্ট্রপরিচালনার গুরুদায়িত্ব পালনেও রয়েছে তার আদর্শ। যারা এ আদর্শ ধারণ করবে, নিজের জীবনে ও কাজে-কর্মে তা বাস্তবায়ন করবে, তারাই হবে আদর্শবান, তারাই হবে সোনার মানুষ। পরপ্রজšে§র জন্য তারা হবে আদর্শ পূর্বসূরি। এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই বনি ইসরাইল বাহাত্তরটি দলে বিভক্ত হয়েছিল আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে তেহাত্তরটি দলে। তাদের একটি ছাড়া সবগুলোই হবে জাহান্নামি। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! সা. সে দল কোনটি? তিনি ইরশাদ করলেন, যার ওপর আমি ও আমার সাহাবিরা প্রতিষ্ঠিত। [জামে তিরমিজি]
অতএব আমাদের উচিত জীবনের সব অঙ্গনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ অনুসরণ করা। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফিক দান করুন। সিরাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আখলাক ও চরিত্র। উম্মুল মুমিনীন আয়েশাকে রা. রাসুলের আখলাক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, কুরআন মাজিদই হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আখলাক। অর্থাৎ রাসুলের গোটা জীবন ছিল কুরআন মাজিদের ব্যবহারিক তাফসির। এ প্রসঙ্গে খোদ কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত। [সুরা : কলম]
নিম্নে উত্তম চরিত্রের কয়েকটি দিক সক্ষেপে তুলে ধরা হলো :

১. তাওয়াক্কুল তথা আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের মধ্যে সত্তর হাজার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে, যারা মন্ত্র-তন্ত্র ব্যবহার করে না, কুলক্ষণ গ্রহণ করে না এবং যারা তাদের প্রতিপালকের ওপর ভরসা রাখে। [সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম]   হযরত ওমর রা. বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে,  তোমরা যদি আল্লাহর ওপর যথাযথ ভরসা কর তাহলে তিনি তোমাদের পাখিদের মতো রিজিক দান করবেন। পাখিরা সকালে খালি পেটে বের হয় অথচ সন্ধ্যায় ফিরে আসে উদরপূর্তি হয়ে। [জামে তিরমিজি, সুনানে ইবনে মাজাহ]

২. ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মুমিনের এই বিষয়টি খুবই আশ্চর্যজনক যে, সব অবস্থায়ই তার জন্য কল্যাণকর। আর এটি শুধু মুমিনেরই  বৈশিষ্ট্য। সুখ ও আনন্দের কিছু হলে সে শোকর আদায় করে। ফলে এটি তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর দুঃখ-কষ্ট এলে সে সবর ও ধৈর্য ধারণ করে, এটাও তার জন্য মঙ্গলজনক। [সহিহ মুসলিম]

৩. অল্পতে তুষ্ট থাকা : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সে ব্যক্তি সফলকাম যে ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং তাকে পরিমিত রিজিক প্রদান করা হয়েছে। আর আল্লাহ তাআলার দেয়া রিজিকে তাকে তুষ্ট করে দিয়েছেন। [সহিহ মুসলিম]

৪. অঙ্গীকার রক্ষা করা : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি: ক) কথা বললে মিথ্যা বলা খ) অঙ্গীকার করলে তা রক্ষা না করা ও গ) আমানত রাখলে খেয়ানত করা। [সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম]

৫. বিনয় : উমর রা. মিম্বরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন, হে লোকসব! তোমরা বিনয় অবলম্বন কর। কেননা, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য বিনয় অবলম্বন করবে আল্লাহ তাআলা তার মর্যাদাও বুলন্দ করে দেবেন।

৬. সত্যবাদিতা : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা সত্যবাদিতা অবলম্বন কর। কেননা, সত্যবাদিতা পুণ্যের দিকে নিয়ে যায়। [সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম]

৭. লজ্জাশীলতা : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, প্রতিটি ধর্মেরই একটি বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্য থাকে। আর ইসলামের বৈশিষ্ট্য হলো লজ্জাশীলতা। [সুনানে ইবনে মাজাহ]

৮. নম্রতা : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা কোমল আর তিনি কোমলতা পছন্দ করেন। [সহিহ মুসলিম] অন্য হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি নম্রতা থেকে বঞ্চিত  সে অনেক কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত। [সহিহ মুসলিম]

৯. অন্যের প্রতি দয়া : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি মানুষের ওপর দয়া করে না আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না। [সহিহ বুখারি]

১০. বদান্যতা ও দানশীলতা : হজরত জাবের রা. বলেন, কখনও এমন হয়নি যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কিছু চাওয়া হয়েছে আর তিনি ‘না’ বলেছেন। [সহিহ বুখারি]

১১. পরোপকার : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সব সৃষ্টিই আল্লাহর পোষ্য। সব সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে পছন্দীয় ওই ব্যক্তি যে আল্লাহর পোষ্যের সঙ্গে অনুগ্রহ প্রদর্শন করে। [বায়হাকি]
চরিত্র গঠনে মহানবী সা. -এর দিক নির্দেশনা
মানব জীবনে আখলাকের গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ তার মনে প্রোথিত মূল্যবোধ ও গুণাবলির আলোকেই সম্পাদিত হয়। দার্শনিক ঈমাম গাজ্জালীর মতে  যেমন গুণাবলি মানব মনে জাগরুক থাকে তারই প্রতিফলন তার বাহ্যিক কাজ-কর্মে প্রকাশিত হয়। এর আলোকে  বলা যায় মানুষের কোন কাজই তার মূল চিন্তা-চেতনা বহির্ভূত নয়।
এ জন্যই যুগে যুগে সংস্কারকরা মানুষের সংশোধন ও পবিত্র জীবন যাপনের পন্থা হিসেবে তাদের আত্মার পরিশুদ্ধি ও মূল্যবোধের জ্ঞান প্রথমেই শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতেন। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের উন্নতি-অবনতি, উত্থান-পতন, মান-সম্মান ইত্যাদি সব কিছুই তাদের মানসিক বিকাশ ও মূল্যবোধ জাগ্রত করার ওপরই নির্ভর করে। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে ইরশাদ হচ্ছে: “আল্লাহ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না যে পর্যন্ত না তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনে এগিয়ে আসে”। [সুরা আর-রা’দ, ১১]
চারিত্রিক উন্নতি বিকাশকে ইসলাম অত্যধিক গুরুত্বারোপ করে থাকে, এমনকি তা ইসলামী শিক্ষার অন্যতম একটি কোর্স হিসেবে পরিগণিত করা হয়। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ হতে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ তথা সমগ্র মানব সমাজের চারিত্রিক উন্নয়নে প্রচুর নির্দেশনা বিদ্যমান। মূলত মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য এ চরিত্রের আলোকেই হয়ে থাকে। আখলাকের মাধ্যমেই মানুষ মনুষ্যত্বের চূড়ান্ত মানে উন্নীত হতে পারে। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন-বিধান। এ বিধানের পরিপূর্ণতার জন্য তাতে উন্নত চরিত্রের বিধান থাকা আবশ্যক। তাই ইসলামে ‘আখলাকুল হাসানাহ’্ তথা উন্নত চরিত্রের স্থান অনেক ঊর্ধ্বে। নিম্নের আলোচনায় তার প্রতি ইঈিত প্রদান করা হচ্ছে।
পৃথিবীতে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের নিমিত্তে আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রাসুলদের প্রেরণ করেছেন। আমাদের প্রিয়নবী সা. কে প্রেরণের  অন্যতম কারণ সচ্চরিত্রের বিকাশ সাধন। নবী করীম সা. বলেন: “আমাকে সচ্চরিত্রের পূর্ণতা সাধনের নিমিত্তই প্রেরণ করা হয়েছে।”[   ] একদা জনৈক ব্যক্তি রাসুল সা. কে দীনের সংজ্ঞা জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বলেন: “উত্তম চরিত্র”। এ কথা দ্বারা বুঝা যায় সচ্চরিত্র বা উত্তম চরিত্র দীনের অন্যতম রুকন, যা ব্যতীত দীনের অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। যেমন হজ্ব সম্পর্কে রাসূলের বাণী: “হজ্বের গুরুত্বপূর্ণ একটি রুকন হচ্ছে আরাফায় অবস্থান করা” যা ব্যতীত হজ্ব আদায় হয় না, তেমনি ভাবে সচ্চরিত্র ব্যতীত দ্বীনও পরিপূর্ণ হয় না।
কেয়ামতে আমলনামা ভারী হওয়া: এ প্রসঙ্গে রসূলের বাণী: ‘কেয়ামতের মাঠে হিসাব-নিকাশের সময় ’আল্লাহ ভীতি ও সচ্চরিত্রের গুণ’ মু’মিনের আমলনামাকে ভারী করবে।’
মু’মিনদের মানগত বিন্যাস: মু’মিনরা সবাই ঈমানদার হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে গুণগত দিক থেকে পার্থক্য রয়েছে। একদা জনৈক ব্যক্তি রাসুল সা.কে উত্তম ঈমানদার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বলেন, “তাদের মধ্যে যে শ্রেষ্ঠ চরিত্রবান সেই উত্তম”। কেয়ামতে রসূলের নৈকট্য অর্জন করা: মু’মিনরা  কেয়ামতে রাসুল সা. এর ভালোবাসা ও নৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে সবাই এক রকম হবে না। এ প্রসঙ্গে রাসুল সা. বলেন:‘কেয়ামতের দিবস তোমাদের মধ্যে আমার নিকট বেশি পছন্দনীয় ও অবস্থানের ক্ষেত্রে অধিক নিকটবর্তী হবে তোমাদের মধ্যে উত্তম চরিত্রের লোকরাই’। পরকালে মুক্তির উপায়: ইসলামের অপরিহার্য ফরজ তথা নামায-রোযা পালন করা সত্ত্বেও পরকালে জাহান্নাম থেকে নাজাত ও জান্নাত লাভের জন্য আখলাক তথা উত্তম চরিত্রের কোন বিকল্প নেই। একদা এক ব্যক্তি রাসুল সা. কে নামাযী ও রোজাদার হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবেশীদের কষ্টদানকারিণী  জনৈকা মহিলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন :“তার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই, সে জাহান্নামী”। 
* রাসুল সা. এর আখলাক সম্পর্কে দোয়া: রাসুল সা. নিজে নিষ্পাপ হয়েও নিজের চরিত্র সুন্দর করার তৌফিক অর্জনের জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করতেন। যেমন তিনি দোয়ায় বলতেন: “আল্লাহ তুমি আমার গঠন-আকৃতি সুন্দর করেছ, আমার চরিত্রকেও সুন্দর করে দাও”। আল্লাহ কর্তৃক রাসুল সা. এর চরিত্রের প্রশংসা: পবিত্র কুরআনের বাণী :“আপনি মহান চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত”। আয়াতে মহান আল্লাহ কর্তৃক রাসুল সা. এর আখলাকের প্রশংসা করার মাধ্যমে ইসলামে এর অবস্থান সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে।
কুরআনে আখলাকের আয়াতের আধিক্য: পবিত্র কুরআনের প্রচুর আয়াতে আখলাকের বিবরণ ও চরিত্রবানদের প্রশংসার বাণী উদ্ধৃত হয়েছে, মাক্কী ও  মাদানী উভয় সুরাগুলোতে আখলাকের নির্দেশ বেশি থাকায় এর গুরুত্বেরও আধিক্য বুঝা যায় যা থেকে কোন মুসলিমের দূরে থাকা অসম্ভব।

গুহাতে আশ্রয় গ্রহণকারী তিন ব্যক্তির গল্প


আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি, ‘তোমাদের পূর্বের যুগে তিন ব্যক্তির একটি দল কোথাও যাত্রা করেছিল, যাত্রাপথে রাত যাপনের জন্য একটি গুহাতে তারা আগমন করে এবং তাতে প্রবেশ করে। অকস্মাৎ পাহাড়  থেকে একটি পাথর খসে পড়ে  এবং বন্ধ করে দেয়  তাদের উপর গুহামুখ। এমন অসহায় অবস্থায় তারা বলাবলি করছিল, তোমাদেরকে এ পাথর হতে মুক্ত করতে পারবে এমন কিছুই হয়ত নেই। তবে যদি তোমরা নিজ নিজ নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নিকট দুআ কর নাজাত পেতে পার।
তাদের একজন বলল : হে আল্লাহ ! আমার বয়োবৃদ্ধ পিতা-মাতা ছিলেন, আমি তাদেরকে দেওয়ার পূর্বে আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্য স্ত্রী-সন্তান ও গোলাম-পরিচারকদের কাউকে রাতের খাবারে দুগ্ধপেশ করতাম না।
একদিনের ঘটনা : ঘাসাচ্ছাদিত চারণভূমির অনুসন্ধানে বের হয়ে বহু দূরে চলে গেলাম। আমার ফেরার পূর্বেই তারা ঘুমিয়ে পরেছিলেন। আমি তাদের জন্য রাতের খাবার দুগ্ধ দোহন করলাম। কিন্তু দেখতে পেলাম তারা ঘুমাচ্ছেন। তাদের আগে পরিবারের কাউকে- স্ত্রী-সন্তান বা মালিকানাধীন গোলাম- পরিচারকদের দুধ দেয়াকে অপছন্দ করলাম। আমি পেয়ালা হাতে তাদের জাগ্রত হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম, এতেই সকাল হয়ে গেল। অতঃপর তারা জাগ্রত হলেন এবং তাদের রাতের খাবার দুধ পান করলেন। হে আল্লাহ ! আমি এ খেদমত যদি আপনার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি, তাহলে এ পাথরের মুসিবত হতে আমাদের মুক্তি দিন। তার এই দুআর ফলে পাথর সামান্য সরে গেল, কিন্তু তাদের বের হওয়ার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লাম বলেন অপর ব্যক্তি বলল : হে আল্লাহ! আমার একজন চাচাতো বোন ছিল, সে ছিল আমার নিকট সমস্ত মানুষের চেয়ে প্রিয়। আমি তাকে পাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলাম। সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করল এবং আমার থেকে দূরে সরে থাকল। পরে কোন এক সময় দুর্ভিক্ষ তাড়িত, অভাবগ্রস্ত হয়ে আমার কাছে ঋণের জন্য আসে, আমি তাকে একশত বিশ দিরহাম দেই এ শর্তে যে আমার এবং তার মাঝখানের বাধা দূর করে দেবে। সে তাতেও রাজি হল। আমি যখন তার উপর সক্ষম হলাম, সে বলল : অবৈধ ভাবে সতীচ্ছেদ করার অনুমতি দিচ্ছি না তবে বৈধভাবে হলে ভিন্ন কথা। আমি তার কাছ থেকে ফিরে আসলাম। অথচ তখনও সে আমার নিকট সবার চেয়ে প্রিয় ছিল। যে স্বর্ণ-মুদ্রা আমি তাকে দিয়েছিলাম, তা পরিত্যাগ করলাম। হে আল্লাহ ! আমি যদি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি, তাহলে আমরা যে মুসিবতে আছি, তা হতে মুক্তি দাও। পাথর সরে গেল তবে এখনও তাদের বের হওয়ার জন্য তা যথেষ্ট হল না।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তৃতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! আমি কয়েকজন মজুর নিয়োগ করেছিলাম, অতঃপর তাদের পাওনা তাদের দিয়ে দিই। তবে এক ব্যক্তি ব্যতীত, সে নিজের মজুরি পরিত্যাগ করে চলে যায়। আমি তার মজুরি বার বার ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছি। যার ফলে সম্পদ অনেক বৃদ্ধি পায়। অনেক দিন পরে সে আমার কাছে এসে বলে, হে আব্দুল্লাহ, আমার মজুরি পরিশোধ কর। আমি তাকে বললাম, তুমি যা কিছু দেখছ উট, গরু, বকরি, গোলাম সব তোমার মজুরি। সে বলল : হে আব্দুল্লাহ ! তুমি আমার সাথে উপহাস করো না। আমি বললাম, উপহাস করছি না। অতঃপর সে সবগুলো গ্রহণ করল এবং তা হাঁকিয়ে নিয়ে গেল। কিছুই রেখে যায়নি। হে আল্লাহ ! আমি যদি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি, তাহলে আমরা যে মুসিবতে আছি তা হতে মুক্তি দাও। পাথর সরে গেল। তারা সকলে নিরাপদে হেঁটে বের হয়ে আসল। ঘটনাটি ইমাম বোখারি ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন। [বুখারি : হা.২১১১]
হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবি বিশিষ্ট সাহাবি আবু আব্দুর রহমান, আব্দুল্লাহ বিন উমর ইবনুল খাত্তাব বিন নোফাইল আল-কোরাইশি আল ‘আদাওয়ি আল-মাক্কি আল-মাদানি। তিনি ছিলেন বরণীয়, অনুসরণীয় একজন পথিকৃৎ ইমাম। শৈশবে ইসলাম গ্রহণ করেন। যখন পিতার সাথে হিজরত করেন তখনও তিনি সাবালক হননি। বয়স কম থাকার কারণে ওহুদের যুদ্ধে তাকে অংশ নেয়ার  অনুমতি দেয়া হয়নি। তার প্রথম যুদ্ধ খন্দক। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত গাছের নীচে যারা বায়আত গ্রহণ করেছিলেন, তিনি তাদের একজন। রাসুল সা. এবং খোলাফায়ে রাশেদীন হতে অনেক হাদিস বর্ণনা করেন তিনি। তিনি ৭৩ হি. সনে ইন্তেকাল করেন।
হাদিসের তাৎপর্য ও শিক্ষা
অত্র হাদিসটি অনেক উপদেশ এবং বহু তাৎপর্যপূর্ণ। নিম্নে কতিপয় উল্লেখ করা হল:
১. পূর্ববর্তী লোকদের ঘটনায় অনেক উপদেশ ও শিক্ষা রয়েছে। প্রত্যেক মুসলমানের উচিত এ সমস্ত ঘটনা গভীরভাবে চিন্তা করা এবং দৈনন্দিন জীবনে এ থেকে উপকৃত হওয়া। আল্লাহ তাআলা আমাদের কাছে পূর্ববর্তী রাসুল সা. ও অন্যান্য লোকের অনেক ঘটনা বর্ণনা করেছেন। উদ্দেশ্য একটাই যাতে পরবর্তীগণ পূর্ববর্তীদের থেকে উপকৃত হয়। উপদেশ গ্রহণ করে ও শিক্ষা অর্জন করে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
 لَقَدْ كَانَ فِي قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ ۗ مَا كَانَ حَدِيثًا يُفْتَرَىٰ وَلَٰكِن تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ كُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
‘তাদের কাহিনীতে বুদ্ধিমানদের জন্য রয়েছে শিক্ষণীয় বিষয়, এটা কোন মনগড়া কথা নয়, কিন্তু যারা বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের জন্যে পূর্বেকার কালামের সমর্থন।’ [সুরা ইউসুফ : ১১১]
২. ঘটনা মূলক বর্ণনা পদ্ধতি, মূল বিষয় বস্তু আত্মস্থ করতে শ্রোতা ও পাঠকগণকে খুব দ্রুত আকৃষ্ট করে। ফলে সহজেই গ্রহণ করে এবং তার উপর আমল করে। এ জন্য রাসুল সা. অনেক সময় সাহাবায়ে কেরামদের জন্য ঘটনা মূলক উদাহরণ পেশ করতেন। খতিব বা বক্তাগণ যখন মানুষের সামনে খুতবা পেশ করেন, তাদের উচিত সুযোগ মত এ পদ্ধতি অবলম্বন করা। কারণ, মানুষের বিচার-বুদ্ধি, প্রকৃতি ও স্বভাবের উপর এর সফল প্রভাব পরে।
৩. খাঁটি বিশ্বাস ও খালেস তওহিদ সবচেয়ে বড়  আমল যা মানুষকে ইহকালীন মুসিবত ও পরকালীন শাস্তি হতে নাজাত প্রদান করে। ঘটনায় বর্ণিত তিন জন লোক স্বীয় দৃষ্টিতে পূর্ণ আন্তরিকতা বা এখলাছসহ সম্পাদনকৃত সর্বোত্তম আমল-এর ওসিলা দিয়ে দুআ করার ব্যাপারে একমত হয়েছে। যার দ্রুত ফল তারা দুনিয়াতেই পেয়ে গেছে।
৪. আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সম্পাদিত নেক আমলের বরাত দিয়ে দুআ করার বৈধতা প্রমাণিত হয়। তাছাড়া অন্য কোন জিনিস যেমন গাছ, কবর, মাজার ও পীর-আউলিয়াদের ওসিলা কিংবা বরাত দিয়ে দুআ করা বা তাদের আহ্বান করা, শিরকে আকবর যা দ্বীন থেকে বের করে দেয়। যার প্রমাণ আল্লাহ তাআলার বাণী-
إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ عِبَادٌ أَمْثَالُكُمْ
‘আল্লাহ তাআলাকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদেরকে ডাক, তারা সবাই তোমাদের মতই বান্দা।’ [সুরা আরাফ : ১৯৪]
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন-
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ ۚ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ
‘বলুন, তোমরা তাদেরকে আহ্বান কর, যাদের উপাস্য মনে করতে আল্লাহ তাআলা ব্যতীত। তারা নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডলের অণুপরিমাণ কোন কিছুর মালিক নয়, এতে তাদের কোন অংশও নেই এবং তাদের কেউ আল্লাহ তাআলার সহায়কও নয়। যার জন্য অনুমতি দেয়া হয়, তার জন্য ব্যতীত আল্লাহ তাআলার কাছে কারও সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না।’ [সুরা সাবা : ২২-২৩]
৫. দুআ সর্বোত্তম এবাদত। মোমিন ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের সর্বোত্তম মাধ্যম। কারণ দুআতে বান্দা আল্লাহ তালার প্রতি সর্বাঙ্গে ধাবিত হয়। এতে নিজের দারিদ্র্য, হীনতা, অপারগতা ও সামর্থহীনতাকে প্রকটভাবে উপলব্ধি করে। উপরোক্ত তিনজন লোক সব কিছু হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুআর মাধ্যমে এবং নেক আমলের ওসিলা দিয়ে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তাআলার শরণাপন্ন হয়েছে যাতে তিনি তাদেরকে আক্রান্ত মুসিবত হতে মুক্ত করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব। যারা আমার এবাদতে অহংকার করে তারা সত্বরই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে।’ [সুরা গাফের : ৬০]
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন- ‘আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে বস্তুত আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নিই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস রাখা তাদের কর্তব্য। যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে।’ [বাকরা : ১৮৬]
৬. অত্র হাদিস দ্বারা পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার, আনুগত্য, তাদের অধিকারের প্রতি যতœবান হওয়া, তাদের খেদমত আঞ্জাম দেয়া এবং তাদের জন্য পরিশ্রম ও কষ্ট করার ফজিলত প্রমাণিত হয়।
পিতা-মাতার কতিপয় উল্লেখযোগ্য অধিকার
ক. তাদের নির্দেশ পালন করা, যদি তাতে আল্লাহ তাআলার নাফরমানি না হয়। বৈষয়িক বিষয়গুলো পূর্ণ করা। শক্তি ও অর্থের মাধ্যমে সাহায্য করা। নরম ভাষায় সম্বোধন করা। বিরুদ্ধাচরণ না করা। তাদের জন্য দুআ করা।
খ. তাদের জন্য বেশি বেশি দুআ করা। তাদের পক্ষ হতে সদকা করা। তারা যে ওসিয়ত করেছেন, তা পূর্ণ করা। তাদের সাথে সম্পর্কিত আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সম্পর্ক অক্ষুণœ রাখা। বন্ধু-বান্ধবদের সম্মান করা। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহু’ শব্দটিও বলো না, এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না এবং তাদের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বল। তাদের সামনে ভালোবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বল: হে পালনকর্তা ! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে   শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।’ [সুরা ইসরা : ২৩-২৪]
৭. পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার দুনিয়ার সমস্যার সমাধান এবং আখেরাতের শাস্তি হতে নাজাতের ওসিলা। পিতা-মাতার আজ্ঞাবহ আলোচিত ব্যক্তির সদ্ব্যবহার তাদের সবার উপর থেকে পাথর হটে যাওয়ার একটি কারণ ছিল। আবু দারদাহ রা. বর্ণনা করেন রাসুল সা. বলেছেন-
‘পিতা জান্নাতের মধ্যবর্তী দরজা, তোমার ইচ্ছা এ দরজাকে সংরক্ষণ কর অথবা নষ্ট কর।’ [তিরমিযি : হা. ১৯০০, মুসনাদে আহমদ : ৬/৪৪৫]
পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার যেমন জান্নাত লাভের ওসিলা; তদ্রুপ তাদের সাথে দুর্ব্যবহার ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতের জন্য শাস্তি যোগ্য অপরাধ। রাসুল সা. বলেন-
ثلاثة لا يدخلون الجنة: العاق لوالديه والديوث ورجلة النساء
‘তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না পিতা-মাতার বিরুদ্ধাচরণকারী; অসতী স্ত্রীর স্বামী; পুরুষের আকৃতি ধারণকারী নারী।’ [নাসাঈ : ২৫১৫]
৮. ইসলাম বাহ্যিক পবিত্রতা, অভ্যন্তরীণ পরিচ্ছন্নতার প্রতি যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছে। এর উপর ভিত্তি করে দুনিয়া ও আখেরাতে অনেক উত্তম প্রতিদানের হিসাব কষেছে। আমরা লক্ষ্য করি মেয়েটি যখন আলোচ্য লোকটিকে আল্লাহ তাআলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, লোকটি সাথে সাথে অশ্লীলতা হতে বিরত থাকে। যার কারণে তারা পাথর হতে মুক্তি পেয়েছে। এটা তাদের নগদ প্রতিদান। এছাড়া আল্লাহ তাআলার নিকট যা রক্ষিত আছে তা আরো উত্তম ও চিরস্থায়ী।
৯. প্রকৃত মুমিন অশ্লীলতা ও গর্হিত বিষয় হতে দূরে থাকে। গুনাহ ও পাপ-পঙ্কিলতার নিকটবর্তী হয় না। সে এ নিষ্পাপ অবস্থাতেই আল্লাহ তাআলার সাথে সাক্ষাৎ করতে চেষ্টা করে।
১০. আমানত এক গুরুত্বপূর্ণ মহান দায়িত্ব। এর মর্যাদা আল্লাহ তাআলা এবং মানুষের কাছে অনেক বেশি। আল্লাহ তাআলা আসমান, জমিন ও পাহাড়ের উপর আমানত পেশ করে ছিলেন, তারা তা বহন করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে, শঙ্কিত হয়েছে। কিন্তু দুর্বল মানুষ তা গ্রহণ করেছে। এখন সে এ আমানত যথাযথ আদায় করলে দুনিয়া-আখেরাতে এর প্রতিদান পাবে। অন্যথায় তার শাস্তির কারণ হবে।
বিশেষ কয়েকটি আমানত
ক. আল্লাহ তাআলার তওহিদকে আঁকড়ে ধরা।
খ. সব ধরণের নেক কাজ সম্পাদন করা।
গ. ব্যাপকভাবে সবার অধিকার বাস্তবায়ন করা। বিশেষ করে গচ্ছিত সম্পদ, জামানত ও অর্থনৈতিক লেনদেন পরিশোধ করা।
১১. সব ধরণের নেক আমল দ্বারা দুনিয়া ও আখেরাতের অনেক জটিল ও কঠিন সংকটের উত্তরণ সম্ভব। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَل لَّهُ مَخْرَجًا [٦٥:٢]  وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ
‘আর যে আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে, আল্লাহ তাআলা তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেবেন।’ [সুরা তালাক : ২-৩]

সুরা ইয়াসিন এর আলোকে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও কর্তব্য

ইয়াসিন পবিত্র কুরআনের ৩৬তম সুরা যা অবতীর্ণ হয়েছে পবিত্র মক্কাতে। এই সুরায় রয়েছে পাঁচটি করুকূ ও ৮৩টি আয়াত। ইয়াসিন শব্দটি হুরূফ আল-মুকাত্তা’আত। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন সুরার প্রথমে এ ধরণের বিচ্ছিন্ন অক্ষরসমূহ রয়েছে যার প্রকৃত অর্থ অন্তর্ণিহিত তাৎপর্য কেবলমাত্র আল্লাহ পাক জানেন। মহান স্রষ্টা আল্লাহ তাআলা সব জ্ঞানের নির্যাস বিজ্ঞানময় আল কুরআন নাযিল করেছেন তাঁর সর্বশেষ রাসুল সা. এর উপর। যাতে তাঁর প্রিয় বান্দারা সতর্ক হতে পারে, সঠিক পথ পেতে পারে এবং জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য, গন্তব্য ও কর্তব্য সম্পর্কে জেনে সে অনুযায়ী নিজেকে পরিচালিত করতে পারে।
আল কুরআনের সুরা ইয়াসিনে মানুষের চূড়ান্ত সাফল্যের বিষয়ে সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। হয় সে এই দিক নির্দেশনা অনুসরণ করে চিরস্থায়ী পরম শান্তিময় জান্নাতে তার দয়াময় প্রভুর ‘সালাম’ লাভ করবে। অথবা এর বিপরীতে কৃত অপরাধের শাস্তি স্বরূপ দয়াময় প্রভুর ‘সালাম’ লাভকারীদের থেকে পৃথক হয়ে অপরাধী হিসেবে নিক্ষিপ্ত হবে চিরস্থায়ী কঠিন শান্তির দুঃসহ যন্ত্রণাময় জাহান্নামের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুন্ডে।
মহান স্রষ্টা তাঁর বান্দাদের চূড়ান্ত গন্তব্য হিসেবে এ দু’টো স্থানকে নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং এর যে কোনো একটিকে গ্রহণ করার স্বাধীনতা, এখতিয়ার মানুষকে দিয়েছেন। তবে “তাদের অধিকাংশের সম্পর্কেই স্থির সিদ্ধান্ত রয়েছে যে, তারা ঈমান আনবে না।” [সুরা ইয়াসিন:৭] এক্ষেত্রে রাসুল সা. এবং তাঁর উম্মতদের দায়িত্বের ব্যাপারে আল্লাহ পাক সুরা ইয়াসিনে পরিস্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন- “আর (আল্লাহর পাকের মহান বাণী) সুস্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়া ব্যতীত আমাদের উপর আর কোনো দায়িত্ব নাই।” [সুরা ইয়াসিন : ১৭]
বিতাড়িত অভিশপ্ত শয়তানের সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা হচ্ছে মানুষকে বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট করে আল্লাহর ইবাদত থেকে দূরে সরিয়ে রেখে স্বীয় উপাসনায় আকৃষ্টের মাধ্যমে জাহান্নামের পথে তাকে ধাবিত করা। মানুষের প্রকাশ্য শত্র“ অবাধ্য, দাম্ভিক শয়তানের উপাসনা হচ্ছে চরমতম অপরাধ যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি সীমাহীন যন্ত্রণাদায়ক জাহান্নাম। প্রতারক শয়তানের ধোঁকা থেকে মানুষকে রক্ষা করে সঠিক পথ দেখানোর জন্যে মহান স্রষ্টা যুগে যুগে নবী রাসুল পাঠিয়েছেন। আল্লাহ পাক এ জন্যে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, “অনুকরণ কর তাঁহাদের যাঁহারা তোমাদের নিকট কোনো বিনিময় চাহেন না। এবং তাঁহারা সঠিক পথপ্রাপ্ত।” [সুরা ইয়াসিন : ২১] কিন্তু শয়তানের পদলেহনকারী পাপিষ্ঠ দুর্বৃত্তদের দ্বারা কেবল নবী রাসুলগণ নন তাঁদের অনুসারীরাও নির্যাতিত হয়েছেন, শাহাদৎ লাভ করেছেন। আর পরিণতিতে শাহাদাতের মর্যাদা লাভকারীরা মহান প্রভুর প্রশান্তিময় জান্নাত লাভে ধন্য ও পরিতৃপ্ত হয়েছেন। সেখানে আক্ষেপ শুধুমাত্র এটুকু যে, দয়াময় মেহেরবান প্রভুর এই অসীম ক্ষমা এবং অকল্পনীয় মর্যাদা, সম্মান, সৌভাগ্যের কথা যদি তাঁর সম্প্রদায়ের সবাই জানতে পারতো। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, তাকে বলা হলো জান্নাতো প্রবেশ কর। সে বলল, ‘হায়! আমার কওম যদি জানতে পারতো! [সুরা ইয়াসিন : ২৬]
ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে মানুষের আসল গন্তব্য চিরস্থায়ী ঠিকানায় পৌঁছার লক্ষ্যে মহান প্রভুর সামনে সবাইকে অবশ্যই দাড়াতে হবে। সুরা ইয়াসিনে কিয়ামতের পরিস্কার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। “আর শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে তখনই তারা ছুটে আসবে তাদের প্রতিপালকের দিকে।” [সুরা ইয়াসিন : ৫১] কিয়ামতের প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে আল্লাহ তা’আলা তাঁর কিতাবসমূহে এবং নবী রাসুলদের মাধ্যমে বারবার তুলে ধরে তাঁর বান্দাদের সঠিক জ্ঞান দান করেছেন। এই কিয়ামত যে অবশ্যই সংঘঠিত হবে সে খবর প্রথম মানব ও নবী হযরত আদম আ. থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী হযরত মোহাম্মাদ সা. পর্যন্ত এক লাখ বা দু’ লাখ চব্বিশ হাজার নবী রাসুলের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মানুষকে জানিয়েছেন। নবী রাসুলগণ প্রত্যেকেই ছিলেন পরম সত্যবাদী, সম্পূর্ণ নিঃস্বর্থ এবং তাদের সময়ের সর্বোত্তম মানব। “তারা বলবে, হায়! দুর্ভোগ আমাদের! কে আমাদেরকে আমাদের নিদ্রাস্থল হতে উঠালো? (তাদের বলা হবে) এটা তো তা যার প্রতিশ্র“তি পরমকরুণাময় করেছিলেন এবং রাসুলগণ সত্যই বলেছিলেন।” [সুরা ইয়াসিন : ৫২]
মহাবিচারক আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা কিয়ামতের দিন তাঁর বান্দাদের প্রতি সুনিশ্চিতভাবে সুবিচার করবেন। দুনিয়াতে যে যেরকম আমল করেছে কিয়ামতের দিন তার প্রতিফল সে অনুযায়ী দেয়া হবে। কিয়ামতে ন্যায়বিচাররের বিষয়ে আল্লাহর সুস্পষ্ট ঘোষণা- “আজ কারো প্রতি কোনো যুলুম করা হবে না এবং তোমরা যা আমল করছিলে কেবল তারই প্রতিফল দেয়া হবে।” [সুরা ইয়াসিন : ৫৪]
মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে সামান্য শুক্রকীট থেকে। জোড়ায় জোড়ায় সব প্রাণীর সৃষ্টি, আসমান ও যমীনের সৃষ্টি, চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্রের নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণ, দিন ও রাতের আবর্তন, দীর্ঘ জীবন লাভের পর শারীরিক আকৃতির পরিবর্তন, মৃতকে পুণর্জীবিত করা, নৌযানের চলাচল, নির্জীব পৃথিবীকে সজীব করা, জান্নাত জাহান্নাম সৃষ্টি, শিংগায় ফুৎকারের মাধ্যমে কিয়ামতের উদ্ভব, আখিরাতে মানুষের প্রভুর পানে ছুটে চলা ও মুখ বন্ধ হয়ে হাত পা’র কথা বলা, সবুজ বৃক্ষ হতে আগুনের সৃষ্টি, ‘হও’ শব্দটি বলা মাত্র বান্তুবে প্রকৃতপক্ষে তা হয়ে যাওয়া সব কিছুই মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলার অপার কুদরত। এই কুদরতগুলোর অপরূপ ও অতুলনীয় বর্ণনা উপমাসহ অথবা উপমা ছাড়াই সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে সুরা ইয়াসিনে।
আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয়তম রাসুল সা.-এর উপর নাযিল করেছেন সর্বোচ্চ সাহিত্য ও কাব্য গুণসম্পন্ন জ্ঞানগর্ভ এই কুরআন। তবে তাঁকে তিনি কবিতা শিক্ষা দেননি। এটা তাঁর জন্যে শোভনীয়ও নয়। আল কুরআন হচ্ছে সর্বোত্তম উপদেশ ও সুস্পষ্ট সতর্কবাণী। এই কুরআন দুনিয়াতে জীবিতদের সতর্ক করে আর আখিরাতে কাফিরদের বিরুদ্ধে আল্লাহর ওয়াদার সত্যতার সক্ষ্য দিবে। [সুরা ইয়াসিন : ৩৯] প্রকৃতপক্ষে একনিষ্ঠভাবে ও একাগ্রচিত্তে দয়াময় প্রভু আল্লাহর ইবাদত করাই হচ্ছে একমাত্র সঠিক পথ। [সুরা ইয়াসিন : ৬১] কাজেই বৃদ্ধিমানের কথা হচ্ছে সুরা ইয়াসিনের ২২নং আয়াতের আলোকে, “আমার কি যুক্তি আছে যে, (আল্লাহ) যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং যাঁর নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে আমি তাঁর ইবাদত করবো না?”