মহান আল্লাহ তায়া’লা ইরশাদ করেন

الذين يقيمون الصلوة ومما رزقنهم ينفقون- اولئك هم المومنون حقا- لهم درجت عند ربهم ومغفرة ورزق كريم-

‘‘যারা নামায কায়েম করে এবং আমার দেয়া রিযিক থেকে ব্যয় করে। তারা হল সত্যিকার ঈমানদার। তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মান জনক রিযিক। [ সূরা আনফাল-৩-৪]

Pages

ওহুদ যুদ্ধ

ওহুদ যুদ্ধ


পটভূমি

বদর যুদ্ধে মুসলমানরা জয়লাভ করলো বটে, কিন্তু যুদ্ধের মাধ্যমে তারা যেনো ভীমরুলের চাকে ঢিল ছুঁড়লো। এই প্রথম যুদ্ধেই তারা দৃঢ়তার সঙ্গে কাফিরদের মুকাবেলা করেছিল এবং কাফিরদেরকেও শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়ে পিছু হটতে হয়েছিল। এ ঘটনা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সমগ্র আরব জনগোষ্ঠীকে প্রচণ্ড ভাবে উত্তেজিত করে দিলো। যারা এই নয়া আন্দোলনের দুশমন ছিল , তারা এ ঘটনার পর আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তদুপরি মক্কার যে সব কুরাইশ সর্দার এ যুদ্ধে নিহত হয়েছিল, তাদের রক্তের বদলা নেবার জন্যে অসংখ্য চিত্ত অস্থির হয়ে উঠলো। আরবে যেকোন এক ব্যক্তির রক্তই পুরুষানুক্রমে যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়াতো। আর এখানে তো এমন অনেক ব্যক্তিই নিহত হয়েছিল ,যাদের রক্তমূল্য অসংখ্য যুদ্ধে ও আদায় হতে পারতো না। তাই চারদিকে ঝড়ের আলামত দেখা যেতে লাগলো। ইহুদীদের যে সব গোত্র ইতঃপূর্বে মুসলমানদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেছিলো, তারা চুক্তির কোন মর্যাদা রক্ষা করলো না। এমন কি তারা খোদা,নবুয়্যাত আখিরাত এবং কিতাবের প্রতি ঈমান পোষণের দাবি করার ফলে যেখানে মুসলমানদের সাথে অধিকতর নৈকট্য থাকা উচিত ছিলো,সেখানে মুশরিক কুরাইশদের প্রতিই তাদের সমস্ত সহানুভূতি উপচে পড়তে লাগলো। তারা খোলাখুলিভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে কুরাইশদে কে উত্তেজিত করতে শুরু করলো।বিশেষত কাব বিন আশরাফ নামক বনী নাযির গোত্রের জনৈক্য সরদার এ ব্যাপারে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ও অন্ধ শত্রুতায় লিপ্ত হলো। এ থেকে স্পষ্টত অনুমিত হলো যে, ইহুদীরা না পড়োশী হিসেবে কোন কর্তব্য পালন করবে আর না হযরত (সা:) এর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির মর্যাদা রক্ষা করবে।
এর ফলে মদিনার এই ক্ষুদ্র জনপদটি চারদিক দিয়েই বিপদ পরিবেষ্টিত হয়ে পড়লো। অভ্যন্তরীন দিক দিয়ে মুসলমানদের অবস্থা ছিল এমনিতেই দুর্বল ,তদুপরি যুদ্ধের ফলে তাদেরকে আরো বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হলো।
মক্কার মুশরিকদের অন্তরে এমনিতেই মুসলমানদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিল । তাদের বড়ো বড়ো সর্দারগণ প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে ইতোমধ্যে প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছিল। প্রত্যেক গোত্রের মনেই ক্রোধ ও উত্তেজনা কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছিল। এমনি অবস্থায় ইহুদীগণ কর্তৃক মক্কাবাসীকে যুদ্ধের জন্যে উদ্বুদ্ধ করারচেষ্টা আগুনে তেল ছিটানোর কাজ করলো। ফলে বদর যুদ্ধের পর একটি বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই মদিনায় এই মর্মে খবর পোঁছলো যে, মক্কার মুশরিকগণ এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মদিনা আক্রমনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

কুরাইশদের অগ্রগতি

এই প্রেক্ষাপটে তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসের প্রথম সপ্তাহে হযরত (সা:) কয়েকজন লোককে সঠিক খবর খবর সংগ্রহের জন্যে মদিনার বাইরে প্রেরণ করলেন। তারা ফিরে এসে খবর দিল যে, কুরাইশ বাহিনী মদিনার প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছে। এমনকি তাদের ঘোড়গুলো মদিনার একটি চারণ ভূমি পর্যন্ত সাফ করে ফেলেছে। এবার নবী করীস (সা:) সাহাবীদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। কুরাইশ বাহিনীর মুকাবেলা কি মদিনায় বসে করা হবে , না বাইরে গিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা হবে ? কোন কোন সাহাবী এই অভিমত ব্যক্ত করলেন যে, মুকাবেলা মদিনায় বসেই করতে হবে। কিন্তু বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ পান নি অথচ শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত এমন কতিপয় যুবক দৃঢ়তার সাথে বললেনঃ ‘না, বাইরের ময়দানে গিয়েই তাদের মুকাবেলা করতে হবে। ’ অবশেষে তাদের এই দৃঢ়তা দেখে নবী করীম (সা:) মদিনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

মুনাফিকদের ধোকাবাজি

কুরাইশগণ মদিনার একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে ওহুদ পাহাড়ের পাদদেশে তাদের ছাউনি ফেললো। তার একদিন পর হযরত (সা:) জুম’আর নামাজ বাদ এক হাজার সাহাবী নিয়ে মদিনা থেকে রওয়ানা করলেন। এদের মধ্যে বিশ্বাসঘাতক আবদুল্লাহ বিন উবাইও ছিল। এ লোকটি দৃশ্যত মুসলমান হলেও কার্যত ছিল মুনাফিক ।এর প্রভাবাধীন আরো বহু মুনাফিক মুসলমানদের সঙ্গে যাত্রা করেছিল। কিছুদূর গিয়ে আবদুল্লাহ বিন উবাই তিন’শ লোক নিয়ে হঠাৎ ‘যুদ্ধ হবে না’ বলে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। এখন শুধু সাত শ সাহাবী বাকী রইলেন। এমনি নাজুক অবস্থায় মুনাফিকদের এই আচরণ ছিল গুরুতর মনস্তাত্ত্বিক আঘাতের শামিল । কিন্তু যে সব মুসলমানের হৃদয় আল্লাহর প্রতি ‌ঈমান, আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস এবং সত্যের পথে শহীদ হবার আকাঙ্ক্ষায় পরিপূর্ণ ছিল, এ ঘটনায় তাদের ওপর কোন বিরুপ প্রতিক্রিয়ারই সৃষ্টি হলো না। তাই তারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে সামনে অগ্রসর হলেন।

যুব সমাজের উদ্দীপনা

এ সময় হযরত (সা:) তার সঙ্গী- সাথীদের অবস্থা একবার যাচাই করে নিলেন এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক তরুণদের ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। এদের মধ্যে রাফে ’ ও সামারাহ নামক দুটি কিশোর বালকও ছিল। কিশোরদের কে যখন সেনাবাহিনী থেকে আলাদা করে দেয়া হচ্ছিল , তখন রাফে তার পায়ের অগ্রভাগের ওপর ভর করে দাঁড়ালো। যেনো লম্বায় তাকে কিছু উঁচু দেখায় , এবং তাকে সঙ্গে নেয়া হয়। তার এই কৌশল ফলপ্রসূও প্রমাণিত হলো। কিন্তু সামারাহ সেনাবাহিনীতে থাকবার অনুমতি না পেয়ে বললোঃ ‘রাফেকে যখন রেখে দেয়া হয়েছে , তখন আমাকেও থাকবার অনুমতি দেয়া উচিত । কারণ আমি তাকে কুস্তি প্রতিযোগিতায়া পরাজিত করতে পারি । ’ তার এ দাবির যথার্থতা প্রমাণের জন্যে উভয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হলো। অবশেষে সে রাফেকে পরাজিত করলো এবং তাকেও সেনাবাহিনীতে নিয়ে নেয়া হলো। এ একটি সামান্য ঘটনামাত্র । কিন্তু এতেই আন্দাজ করা চলে যে, মুসলমানদের মধ্যে আল্লাহর পথে জিহাদ করার কতখানি অদম্য আগ্রহ ছিল।

সৈন্যদের প্রশিক্ষণ

ওহুদ পাহাড় মদীনা থেকে প্রায় চার মাইল দূরে অবস্খিত। হযরত (স) এমনভাবে তার সৈন্যদের মোতায়েন করলেন যে, পাহাড় পিছন দিকে থাকলো আর কুরাইশ সৈন্যরা রইলো সামনের দিকে। পিছন দিকে পাহাড়ের মাঝ বরাবর একটি সুড়ঙ্গ পথ ছিলো এবং সে দিক থেকেও হামলার কিছুটা আশাংকা ছিলো। হযরত (স) সেখানে আবদুল্লাহ বিন জুবাইরকে পঞ্চাশ জন তীরন্দাজসহ মোতায়েন করলেন। তাকে এই র্মমে নির্দেশ দিলেন যে, এই সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে কাঊকে আসতে দেয়া যাবে না এবং তুমিও এখান থেকে কোন অবস্থায় নড়বে না। এমন কি যদি দেখো যে, পাখিরা আমাদের গোশ্‌ত ছিঁড়ে নিয়ে খাচ্ছে, তবুও তুমি নিজের স্থান ত্যাগ করবে না

কুরাইদের সাজ-সজ্জা

এবার কুরাইশরা অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণ সাজ-সজ্জা করে এসেছিলো। প্রায় তিন হাজার সৈন্য ও প্রচুর সামান্তপত্র তাদের সঙ্গে ছিলো। তখনকার দিনে যে যুদ্ধে মেয়েরা যোগ দান করতো, তাতে আরবরা জীবনপণ করে লড়াই করতো। তারা মনে করতো, যুদ্ধে যদি পরাজয় হয় তো মেয়েদের বেইজ্জত হবে। এ যুদ্ধেও কুরাইশ বাহিনীর সঙ্গে অনেক মহিলা এসেছিল। এদের মধ্যে আপন পুত্র ও প্রিয়জন মারা গেছে, এমন অনেকেই ছিলো। এতে কেউ কেউ প্রিয়জনদের হত্যাকারীদের রক্তপান করে তবেই নিঃশ্বাস ফেলবে-এমন প্রতিজ্ঞা পর্যন্ত করেছিলো।

যুদ্ধের সূচনা

কুরাইশরা তাদের সৈন্যদেরকে খুব ভালোমতো প্রশিক্ষণ দিয়েছিলো। যুদ্ধের সূচনা-পর্বে কুরাইশ মহিলারা দফ বাজিয়ে আবেগ ও উদ্দীপনাময় কবিতা আবৃতি করতে লাগলো। তারা যোদ্ধদেরকে বদর যুদ্ধে নিহতদের রক্তের বদলা নেবার জন্যে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় উৎসাহ যোগালো। এরপর শুরু হলো যুদ্ধ। প্রথম পর্যায়ে মুসলমানদের দিকেই পাল্লা ভারী রইলো এবং কুরাইশ পক্ষের বহু সৈন্য নিহত হলো।তাদের সৈন্য দের মধ্যে হতাশা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিল । এদিকে সুড়ঙ্গ পথের প্রহরায় নিযুক্ত সৈন্যরা যখন দেখলো যে, মুসলমানরা মাল সংগ্রহে লিপ্ত হয়েছে এবং দুশমনরাও ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে.তখন তারাও গনীমতের মাল সংগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়লো। তাদের নেতা হযরত আবদুল্লাহ বিন জুবাইর বারবার তাদেরকে বিরত রাখতে চাইলেনএবং হযরত (সা:) এর কথাও স্মরণ করিয়ে দিলেন।কিন্তু কতিপয় লোক ছাড়া কেউ তার কথা শুনলো না।

পশ্চাদিক থেকে কুরাইশদের হামলা

খালিদ বিন অলীদ তখন কাফির সৈন্যদের একজন অধিনায়ক। সে এই সুবর্ণ সুযোগ কে পুরোপুরি কাজে লাগানো এবং পাহাড়ের পেছন দিক দিয়ে ঘুরে গিয়ে সুড়ঙ্গ -পথে মুসলমানদের ওপর হামলা করলো।হযরত আবদুল্লাহ এবং তার ক’জন সঙ্গী শেষ পর্যন্ত সুড়ঙ্গ পথের প্রহরায় ছিলেন,তাদের অধিকাংশই এই হামলার মুকাবেলা করলেন।কিন্তু কাফের দের এই প্রচণ্ড হামলাকে তারা প্রতিহত করতে পারলেন না। তারা শহীদ হয়ে গেলেন। অতঃপর দুশমনরা একে একে মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ওদিকে যে সব পলায়নপর কাফির দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছিল , তারাও আবার ফিরে এলো।এবার দুদিক দিয়ে মুসলমানদের ওপর হামলা শুরু হলো।এই অভাবিত পরিস্থিতিতে মুসলমানদের মধ্যে এমন আতঙ্কের সঞ্চার হলো যে, যুদ্ধের মোড়ই সম্পূর্ণ ঘুরে গেলো। মুসলমানেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক ওদিক পালাতে লাগলো। এমনকি আতঙ্কের মধ্যেই গুজব ছড়িয়ে পড়লো যে, নবী করীম(সা:) শহীদ হয়ে গেছেন। এই খবরে সাহাবীদের মধ্যে বাকী উদ্যমটুকুও নষ্ট হয়ে গেলো এবং অনেকে সাহস পর্যন্ত হারিয়ে ফেললো।

আল্লাহর সাহায্য এবং বিজয়

এ সময় দশ-বারো জন সাহাবী নবী করীম(সা:) কে ঘিরে রেখেছিলেন। তিনি অবশ্য আহত হয়েছিলেন। সাহাবীরা তাকে একটি পাহাড়ের ওপর নিয়ে এলেন। অতঃপর অন্য মুসলমানরা ও জানতে পারলেন যে, নবী করীম (সা:) সুস্থ ও নিরাপদ আছেন।তাই তারা আবার দলে দলে তার কাছে একত্রিত হতে লাগলেন। কিন্তু এ সময় কি কারণে যেন কাফিরদের মনোযোগ হঠাৎ অন্যদিকে নিবদ্ধ হলো এবং নিজেদের বিজয়কে পূর্ণ পরিণতি পর্যন্ত না পৌঁছিয়েই তারা ময়দান ছেড়ে চলে গেল।
তারা যখন কিছু্‌টা দূরে চলে গেল, তখন তাদের সম্ভিত ফিরে এলো। তারা পরস্পরকে বললোঃ এ আমরা কি ভুল করলাম ! মুসলমানদের সম্পূর্ণ খতম করে দেবার দুর্লভ সুযোগটিকে নষ্ট করে এমনিই চলে এলাম! এরপর তারা এক জায়গায় থেকে পরস্পর বলাবলি করলোঃ এবার তাহলে মদিনার ওপর আর একবার হামলা করা উচিত । কিন্তু শেষ পর্যন- আর তাদের সাহস হলো না। তারা মক্কায় ফিরে গেলো।
এদিকে নবী করীম (সা:) চিন্তিত ছিলেন যে,শত্রুরা না জানি আবার ফিরে এসে আবার হামলা করে বসে । তাই তিনি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে মুসলমানদের কে দুশমনদের পশ্চাদ্ধাবন করার নির্দেশ দিলেন। এটা ছিল অত্যন্ত নাজুক সময় । কিন্তু যারা সাচ্চা মুমিন ছিল , তারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে পুনরায় জান কুরবান করার জন্যে তৈরি হয়ে গেল । নবী করীম(সা:) হামরা-উল-আসাদ নামক স্থান পর্যন্ত দুশমনদের পশ্চাদ্ধাবন করলেন। এ জায়গাটি মদিনা থেকে ৮ মাইল দূরে অবস্থিত । এখানে পৌঁছে জানা গেল যে, কুরাইশরা মক্কায় ফিরে গেছে। তাই তিনিও মুসলমানদের নিয়ে মদিনায় ফিরে এলেন।
এ যুদ্ধে ৭০ জন সাহাবী শহীদ হলেন। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন আনসার । তাই মদিনায় ঘরে ঘরে শোকের বন্যা নেমে এলো। এ সময় হযরত (সা:) মুসলমানদের শোক প্রকাশের নিয়মাবলী সম্পর্কে অবহিত করলেন।তিনি বললেনঃ ‘মাতম করা এবং ছাতি পিটিয়ে কান্না-কাটি করা মুসলমানদের পক্ষে মর্যাদা হানিকর । ’

বিপর্যয়ের কারণ এবং মুসলমানদের প্রশিক্ষণ

ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের যে বিপর্যয় ঘটে , তার পেছনে মুনাফিকদের চালবাজি ও কলা কৌশলের প্রভাব ছিল সন্দেহ নেই; কিন্তু সেই সঙ্গে মুসলমানদের নিজস্ব দুর্বলতাও কম দায়ী ছিল না । অবশ্য ইসলামী আন্দোলন যে ধরণের মেজাজ তৈরি করে এবং তার কর্মীদের যে রুপ প্রশিক্ষণ দিতে ইচ্ছুক , তার জন্যে তখনও পুরোপুরি সুযোগ পাওয়া যায় নি। আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গ করার এ ছিল দ্বিতীয় সুযোগ মাত্র । তাই এ ক্ষেত্রে স্বভাবতই কিছু কিছু দুর্বলতা প্রকাশ পেলো। যেমনঃ সম্পদের মোহে কর্তব্য অবহেলা করা , নেতার হুকুম অমান্য করা ,দুশমনকে পুরোপুরি খতম করার আগে গনীমতের মালের দিকে মনোযোগ দেয়া ইত্যাদি। এ কারণেই যুদ্ধ শেষ হবার পর আল্লাহ তাআলা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি অত্যন্ত বিস্তৃত ভাবে পর্যালোচনা করলেন। এ পর্যালোচনা ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলমানদের মধ্যে যা কিছু দোষ-ত্রুটি বাকী ছিল , তার প্রতিটি দিককেই তিনি স্পষ্টভাবে তুলে ধরলেন এবং সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলীও প্রদান করলেন।সূরা আল ইমরানের শেষাংশে এই নির্দেশাবলীর কথা বিবৃত হয়েছে। এখানে তার কতিপয় অংশ উদ্ধৃত করা যাচ্ছে। এ থেকে ইসলামী আন্দোলনে যুদ্ধের স্থান কোথায় এবং ইসলামের দৃষ্টিতে যুদ্ধ সংক্রান্ত ঘটনাবলীর ওপর কিভাবে আলোকপাত করতে হয়, তা আর একবার উপলব্ধি করা যাবে।

খোদা-নির্ভরতা

মুসলমানরা যখন যুদ্ধের জন্যে যাত্রা করেছিল ,তখন তাদের সংখ্যা ছিল এক হাজারের মতো। পক্ষান্তরে দুশমনদের সংখ্যা ছিল তিন হাজার। এরপরও কিছুদূর গিয়ে তিন শ’ মুনাফিক আলাদা হয়ে গেল। এবার বাকী থাকলো শুধু সাত শ’ মুসলমান। তদুপরি যুদ্ধের সামান্তপত্র ছিল কম এবং এক তৃতীয়াংশ সৈন্যও গেল বিচ্ছিন্ন হয়ে। এই নাজুক পরিস্থিতিতে কিছু লোকের মনোবল ভেঙ্গে পড়তে লাগলো । এ সময় শুধু আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং তার সাহায্যের ওপর ভরসাই মুসলমানদেরকে দুশমনদের মুকাবেলায় এগিয়ে নিয়ে চললো। এ উপলক্ষে হযরত (সা:) মুসলমানদের কে যে সান্ত্বনা প্রদান করেন, আল্লাহ তা নিম্নোক্ত ভাষায় উল্লেখ করেছেনঃ “স্মরণ করো, যখ,তোমাদের মধ্যকার দুটি দল নির্বুদ্ধিতা প্রদর্শনের জন্যে প্রস্তুত হয়েছিল, অথচ আল্লাহ তাদের সাহায্যের জন্যে বর্তমান ছিলেন। আর মুমিনদের তো আল্লাহর ওপরই ভরসা করা উচিত । এর আগে বদরের যুদ্ধে আল্লাহ তোমাদের শোকরী থেকে তোমাদের বেঁচে থাকা উচিত। আশা করা যায়, এবার তোমরা কৃতজ্ঞ হবে। স্মরণ করো, যখন তুমি (হে নবী) মুমিনদের কে বলেছিলঃ তোমাদের জন্যে এটা কি যথেষ্ট নয় যে, আল্লাহ তিন হাজার ফেরেশতা প্রেরণ করে তোমাদের সাহায্য করবেন। তোমরা যাতে খুশি হও এবং তোমাদের হৃদয় নিশ্চিন্ত হয়, সে জন্যেই আল্লাহ তোমাদের কাছে একথা প্রকাশ করলেন। বিজয় বা সাহায্য যা কিছুই হোক , আল্লাহর কাছ থেকেই আসে । তিনি অত্যন্ত শক্তিমান, বিচক্ষণ । (আলে ইমরান আয়াতঃ১২২-১২৬)
এখানে মুসলমানদের কে শেষ বারের মতো বুঝিয়ে দেয়া হলো যে, প্রকৃতপক্ষে বস্তগত শক্তির ওপর ভরসা করা মুসলমানদের কাজ নয়। তাদের শক্তির আসল উৎস হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং তার সাহায্যের ওপর ভরসা।

ধন-সম্পদের মোহ

ওহুদে মুসলমানদের বিপর্যয়ের আর একটি বড় কারণ হলো এই যে, মুসলমানরা যুদ্ধের ঠিক মাঝখানেই সম্পদের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল এবং দুশমনকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার আগেই সম্পদের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল । এমনকি , যারা সুড়ঙ্গ-পথের প্রহরায় নিযুক্ত ছিল,তাদের মধ্যে পযর্ন্ত দুর্বলতা প্রকাশ পেল। এভাবে যুদ্ধের মোড় সম্পূর্ণ ঘুরে গেল। তাই আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের হৃদয় থেকে ধনের মোহ দূরীভূত করার জন্যে আ সময়ই মোহ সৃষ্টির একটি বড় কারণকে নিশ্চিহ্ন করে দিলেন। অর্থাৎ এ সময় সূদকে হারাম ঘোষণা করা হলো। যারা সূদী কারবার করে , তাদের হৃদয়ে ধনের মোহ এমনি বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, তা আর কোন মহৎ কাজের উপযোগী থাকে না।সূদের ফলেই এক শ্রেণীর মনে লালসা, কার্পণ্য , আত্মকেন্দ্রিকতা এবং ধনের মোহ সৃষ্টি হয়। আর এক শ্রেণীর মধ্যে জাগ্রত হয় হিংসা দ্বেষ ও ক্রোধ-বিক্ষোভ।

সাফল্যের চাবিকাঠি

যদি মনোবলকে সমুন্নত রাখার জন্যে কোন ক্রিয়াশীল শক্তি বর্তমান না থাকে , তাহলে পরাজয়ের পর তা হ্রাস পেতে থাকবেই । ওহুদে মুসলমানদের যে পরাজয় ঘটেছিল , তাতে কিছু লোকের মনোবল ভেঙ্গে পড়ার আশংকা ছিল। কিন্তু এ সময় মুসলমানদের কে এই বলে আশ্বাস দেয়া হলো যে, “ তোমাদের না নিরুৎসাহ হওয়া উচিত আর না দুঃখ প্রকাশ করা উচিত । তোমাদেরই হবে, যদি তোমরা খাঁটি মুমিন হও, ঈমানের ওপর অবিচল থাকো এবং তার দাবি সমূহ পূর্ণ করতে থাকো। তোমাদের কাজ শুধু এটুকুই ; এরপর তোমাদের সমুন্নত করা এবং দুঃখ ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব আল্লাহর । এরপর রইলো তোমাদের এই সাময়িক দুঃখ- ক্লেশ ও পরাজয়ের প্রশ্ন। এটা শুধু তোমাদেরই ব্যাপার নয়, তোমাদের বিরুদ্ধ দলের ওপরও এরকম দুঃখ-মুসিবত এসে থাকে । তারা যখন মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়েও নিরুৎসাহিত হয়না, তখন তোমরা কেন সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে চিন্তা-ভাবনা করো ?তোমরা তো জান্নাতের প্রত্যাশী । তোমরা কি মনে করো, এমনিই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে ? অথচ তোমাদের ভেতর কে আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গ করেছে আর কে তার জন্যে প্রতিকূল অবস্থায়ও ধৈর্য অবলম্বন করতে ইচ্ছুক, আল্লাহ তা এখন পর্যন্ত যাচাই-ই করেননি।(আল -ইমরানঃআয়াত১৩৯-১৪২)

ইসলামী আন্দোলনের প্রাণবস্ত

পৃথিবীর যেকোন আন্দোলনেই তার প্রাণবস্ত কিংবা চালিকা-শক্তিরুপে একজন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব বর্তমান থাকে। কিন্তু আদর্শবাদী আন্দোলনের উন্নতি বা স্থায়িত্ব কোন ব্যক্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং যে নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে এ আন্দোলন উত্থিত হয়, তার দৃঢ়তা ও সত্যতার ওপরই এর সবকিছু নির্ভর করে। ইসলামী আন্দোলনের জন্যে নবীদের ব্যক্তিত্ব কতোখানি গুরুত্বপূর্ণ , তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও এটি একটি আদর্শবাদী আন্দোলন এবং এর উন্নতি ও স্থায়িত্ব সম্পূর্ণত ইসলামের উপস্থাপিত নীতিমালার ওপর নির্ভরশীল। এ কারণে মুসলমানদের এ কথা জানিয়ে দেয়া প্রয়োজন হলো যে, নবীর মহান ব্যক্তিত্ব তাদের ভেতর বর্তমান থাকলেই কেবল তারা আল্লাহর দ্বীনের ঝাণ্ডা সমুন্নত করবে এবং নবীর প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হলে অমনি তারা এ পথ ছেড়ে দিয়ে অন্য কোন পথ অবলম্বন করবে, এরুপ ধারণা যেনো তাদের মনের কোণেও ঠাঁই পায়। ইতঃপূর্বে ওহুদের ময়দানে যখন এই মর্মে গুজব প্রচারিত হলো যে, হযরত (সা:) শহীদ হয়ে গেছেন, তখন কিছু মুসলমানের মনোবল একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিল। তারা ভেবেছিল : হযরতের ছায়াই যখন চলে গেল, তখন আর যুদ্ধ করে কি হবে! এই ভুল ধারণা দূর করার জন্যেই এই সময় মুসলমানদের বুঝিয়ে দেয়া হলোঃ “দেখো,মুহাম্মদ (সা:) একজন রাসূল বৈ কিছুই নন। তার আগেও অনেক রাসূল চলে গেছেন। এখন তিনি যদি মরে যান কিংবা নিহত হন, তাহলে তোমরা কি পশ্চাদপসরণ করবে ? মনে রেখো, যে ব্যক্তি পশ্চাদপসরণ করবে সে আল্লাহর কোনই ক্ষতি করবে না । পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দাহ হিসেবে জীবন যাপন করবে, তাকে তিনি পুরস্কৃত করবেন।”(আল ইমরানঃআয়াত১৪৪)
আরো বলা হলোঃ ‘তোমরা যে দ্বীনকে বুঝে-শুনে গ্রহণ করেছো, তার ওপর অবিচল থাকার এবং তাকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে তোমাদের মধ্যে হামেশা নবীর উপস্থিত মাত্র ।এর ওপর অবিচল থাকলে তোমরা নিজেরাই সুফল পাবে। এ দ্বীনের আসল শক্তি হচ্ছে এর উপস্থাপিত সত্যতা। এর সমুন্নতি না তোমাদের শক্তি -সামর্থের ওপর আর না কোনো বিশেষ ব্যক্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল।’

দুর্বলতার উৎস-১

মানুষের সমস্ত দুর্বলতার উৎস হচ্ছে মৃত্যু-ভয়।তাই এ সময় মুসলমানদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হলো যে, তোমাদের মৃত্যু-ভয়ে পলায়ন করা নিতান্তই অর্থহীন। কারণ মৃত্যুর জন্যে নির্ধারিত সময় না আসা পর্যন্ত কোন প্রাণীরই মৃত্যু হতে পারে না। অন্য কথায় , আল্লাহর নির্ধারিত সময়ের আগে না কেউ মরতে পারে আর না তারপর এক মুহূর্তও কেউ বেঁচে থাকতে পারে। অতএব, তোমাদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচবার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই ; বরং জীবনের যেটুকু অবকাশ পাওয়া গেছে, তা কি দুনিয়াদারিতে ব্যয়িত হচ্ছে না আখিরাতের কাজে ,তা-ই শুধু চিন্তা করা উচিত। কারণ যে ব্যক্তি শুধু দুনিয়াদারির জন্যে তার শ্রম-মেহনত নিয়োজিত করে, তার যা কিছু প্রাপ্য তা দুনিয়ায়ই পেয়ে থাকে।আর যে ব্যক্তি আখিরাতের কল্যাণের জন্যে কাজ করে ,আল্লাহ তাকে আখিরাতেই প্রতিফল দান করবেন।কাজেই যারা আল্লাহর দ্বীন কবুল করার ,এর ওপর কায়েম থাকার এবং একে হারাম করবার চেষ্টা-সাধনার সুযোগ পেয়েছে, তাদের পক্ষে এই মহা মূল্যবান নিয়ামতটিরই কদর করা এবং এর জন্যেই নিজেদের সবকিছু নিয়োজিত করা উচিত । এর ফলাফল অবশ্যই তাদের পক্ষে কল্যাণপ্রদ হবে; আখিরাতের স্থায়ী সাফল্য তারা অর্জন করবে। আর এই নিয়ামতের যারা শোকর আদায় করবে, আল্লাহ তাদেরকে সর্বোত্তম নিয়ামত দ্বারা কৃতার্থ করবেন। তারা আপন মালিকের কাছ থেকে সর্বোত্তম পুরস্কারে ভূষিত হবে।