মহান আল্লাহ তায়া’লা ইরশাদ করেন

الذين يقيمون الصلوة ومما رزقنهم ينفقون- اولئك هم المومنون حقا- لهم درجت عند ربهم ومغفرة ورزق كريم-

‘‘যারা নামায কায়েম করে এবং আমার দেয়া রিযিক থেকে ব্যয় করে। তারা হল সত্যিকার ঈমানদার। তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মান জনক রিযিক। [ সূরা আনফাল-৩-৪]

Pages

হুনাইনের যুদ্ধ

হুনাইনের যুদ্ধ


মক্কা বিজয়ের প্রভাব

হযরত (স)-এর দয়া সুলভ আচরণ এং মুসলমানদের সাথে মেলামেশার ফলে একদিকে মক্কায় দলে দলে লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো, অন্যদিকে তামাম আরব গোত্রের ওপর বিজয়ের এর বিরাট প্রভাব পড়লো। তারা বুঝতে পারলো, ইসলামের প্রতি আহবানকারী বাস্তবিকই ধন-দৌলত বা রাজত্বের কোনো কাঙাল নন; বরং তিনি আল্লাহরই পয়গাম্বর। পরন্ত এ সময়ে ইসলাম ও তার বৈশিষ্ট্য কোনো চোরা-গুপ্তা জিনিস ছিলো না; বরং ইসলামী আদর্শের স্বরূপটা প্রায় গোটা আরব দেশই জেনে ফেলেছিলো। যাদের হৃদয়ে বুঝবার শক্তি ছিলো, তারা বুঝে নিয়েছিলো যে, এই হচ্ছে আসল সত্য। তাই মক্কা বিজিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই আরবের দূর-দূরাঞ্চল থেকে বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা এসে ইসলাম কবুল করতে লাগলো। এতদসত্ত্বেও যে সব লোকের অন্তরে ইসলামী আন্দোলনের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ বর্তমান ছিলো, তারা এ দৃশ্য দেখে যারপর নাই অস্তির হয়ে উঠলো। তাদের ভেতরে বিদ্বেষ ও বিরুদ্ধতার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। এদিক দিয়ে হুনাইনের অধিবাসী হাওয়াজেন ও সাকীফ নামক দুটি গোত্র অত্যন্ত অগ্রবর্তী ছিলো। তারা এমনিতেও খুব যুদ্ধবাজ লোক ছিলো; তদুপরি ইসলামের অগ্রগতি দেখে তারা আরো অস্তির হয়ে পড়লো। তারা স্পষ্টত বুঝতে পারলো, মক্কার পর এবার তাদের পালা। তাই উভয় গোত্রের প্রধানদ্বয় একত্র হয়ে পরামর্শ করলো এবং এই সিদ্ধান্ত নিলো যে, পরিস্তিতি যা-ই হোক না কেন, দৃঢ়তার সাথে মুসলমানদের মুকাবিলা করতে হবে। কারণ ক্রমবর্ধমান বিপদকে প্রতিরোধ করতে না পারলে তাদের কল্যাণ নেই। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা মালিক ইবনে আওফ নাযারী নামক তাদের জনৈক সর্দারকে বাদশাহ মনোনীত করলো এবং মুসলমানদের মুকাবিলা করার জন্যে সর্বাত্নক প্রস্তুতি শুরু করে দিলো। এ ব্যাপারে তারা আরো বহু গোত্রকে নিজেদের সঙ্গী বানিয়ে নিলো।

হুনাইনের যুদ্ধ

এ প্রস্তুতির কথা জানতে পেরে নবী করীম (স)-ও সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এই ক্রমবর্ধমান ফিতনাকে সময় থাকতেই মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে অষ্টম হিজরীর ১০ শাওয়াল প্রায় বারো হাজার মুসলিম সৈন্য নিয়ে হযরত (স) দুশমনের মুকাবিলার জন্যে রওয়ানা হলেন। ঐ সময় মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা ছিলো বিপুল আর তাদের যুদ্ধ-সরঞ্জামও ছিলো প্রচুর। এটা দেখেই তাদের মনে পূর্ণ প্রত্যয় জন্মালো যে, দুশমনরা তাদের মুকাবিলা করতে কিছুতেই সমর্থ হবে না; বরং অচিরেই তারা ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাবে। এমন কি, কোনো কোনো মুসলমানের মুখ থেকে এ উক্তি পর্যন্ত বেরিয়ে পড়লো : ‘আজ আর আমাদের ওপর কে জয়লাভ করতে পারে কিন্তু এরূপ ধারণা মুসলমানদের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে কিছুমাত্রও সামঞ্জস্যশীল ছিল না। কারণ তাদের কখনো আপন শক্তি-সামর্থ্যের ওপর ভরসা করা উচিত নয়। তাদের শক্তি হওয়া উচিত শুধুমাত্র আল্লাহ তা’আলার দয়া ও করুণা। কুরআন পাকে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন :
‘হুনাইনের দিনকে স্মরণ করো, যখন তোমরা নিজেদের সংখ্যাধিক্যতে তুষ্ট ছিলে; কিন্তু তাতে তোমাদের কোনো কাজ হয়নি; বরং জমিন প্রশস্ত থাকা সত্ত্বেও তা তোমাদের জন্যে সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিলো এবং তোমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালিয়েছিলে। অতঃপর আল্লাহ তাঁর রাসূল এবং মুসলমানদের ওপর নিজের তরফ থেকে সান্ত্বনা ও প্রশান্তির ভাবধারা নাযিল করলেন এবং তোমরা দেখতে পাওনি এমন সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে কাফিরদের শাস্তি দিলেন। কাফিরদের জন্যে এমনি শাস্তিই নির্ধারিত।’ (সূরা তাওবাঃ ২৫,২৬)
হুনাইন হচ্ছে মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী একটি উপত্যকা। এখানেই এই ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুসলমানরা সামনে আসা মাত্র দুশমনরা আশ-পাশের পাহাড় থেকে এলোপাথাড়ি তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করলো। এ পরিস্থিতির জন্যে মুসলমানরা মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। এর ফলে তাদের সৈন্যদলে বিশৃংখলা দেখা দিলো এবং কিছুক্ষণের জন্যে তারা ময়দান ত্যাগ করলো। অনেক বেদুইন গোত্র ময়দান থেকে পালিয়ে গেলো। এদের মধ্যে সবেমাত্র ঈমান এনেছে এবং পূর্ণ প্রশিক্ষণ পায়নি এমন অনেক নও-মুসলিমও ছিলো। এই বিশৃংখল পরিস্থিতিতে হযরত (স) অত্যন্ত দৃঢ়তা ও প্রশান্ত চিত্তে যুদ্ধ ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে রইলেন এবং দুশমনদের মুকাবিলা করা ও ময়দান থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন না করার জন্যে মুসলমানদের প্রতি ক্রমাগত আহবান জানাতে লাগলেন। তাঁর এই অপূর্ব ধৈর্য-স্থৈর্য এবং তাঁর চারপাশে বহু সাহাবীর অকৃত্রিম দৃড়তা দেখে মুসলিম সৈন্যরা পুনরায় ময়দানে আসতে শুরু করলো এবং নবতর উৎসাহ-উদ্দীপনা ও শৌর্য-বীর্যের সঙ্গে দুশমনদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। নবী করীম (স) এবং তাঁর সাহাবীদের এই ধৈর্য ও দৃঢ়তাকেই আল্লাহ তা’আলা তাঁর তরফ থেকে অবতীর্ণ সান্ত্বনা ও প্রশান্তির লক্ষণ বলে উল্লেখ করেছেন। এর ফলে আল্লাহর অনুগ্রহে অল্পক্ষণের মধ্যেই যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেলো এবং মুসলমানরা পুরোপুরি জয়লাভ করলো। কাফিরদের প্রায় ৭০ ব্যক্তি নিহত এবং সহস্রাধিক লোক বন্দী হলো।

দুশমনদের পশ্চাদ্ধাবন ও কল্যাণ কামনা

কাফিরদের বাকি সৈন্যদের পালিয়ে গিয়ে তায়েফে আশ্রয় গ্রহণ করলো। কারণ তায়েফকে একটি নিরাপদ স্থান মনে করা হতো। হযরত (স) তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলেন এবং তায়েফ অবরোধ করলেন। তয়েফে একটি মশহুর ও মজবুত দুর্গ ছিলো। এর ভেতরেই কাফিরগণ আশ্রয় গ্রহণ করেছিলো। অবরোধ প্রায় বিশ দিন অব্যাহত রইলো। হযরত (স) যখন ভালোমতো বুঝতে পারলেন যে, দুশমনদের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়েছে এবং এখন আর তাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার কোনো আশংকা নেই, তখন তিনি অবরোধ তুলে নিলেন এবং তাদের জন্যে দোআ করলেন : ‘হে আল্লাহ! সাকীফ গোত্রকে সুপথ প্রদর্শন করো এবং তাদেরকে আমার কাছে হাযির হবার তাওফিক দাও।’ কেবল দ্বীন-ইসলামের জন্যে সংগ্রামকারী খোদার নবী ছাড়া কে এমনি পরিস্থিতিতে একখানি দয়ার্দ্র হৃদয় ও স্নেহশীল হতে পারে এবং বিরুদ্ধবাদীদের জন্যে কল্যাণ কামনা করতে পারে?
১৭