মহান আল্লাহ তায়া’লা ইরশাদ করেন

الذين يقيمون الصلوة ومما رزقنهم ينفقون- اولئك هم المومنون حقا- لهم درجت عند ربهم ومغفرة ورزق كريم-

‘‘যারা নামায কায়েম করে এবং আমার দেয়া রিযিক থেকে ব্যয় করে। তারা হল সত্যিকার ঈমানদার। তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মান জনক রিযিক। [ সূরা আনফাল-৩-৪]

Pages

যে সুন্নাহ প্রত্যাখ্যান করে তার বেলায় বিধান

যে সুন্নাহ প্রত্যাখ্যান করে তার বেলায় বিধান



এই বইয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রমাণিত হয়েছে যার ভিতর রয়েছে:


১) সুন্নাহ হচ্ছে আল্লাহর কাছ থেকে আসা এক ধরণের ওহী।
২) সুন্নাহর অবস্থান ও মর্যাদা কুর’আনের বহু আয়াত দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে। কেউ যদি দাবী করে যে, সে কুর’আন অনুসরণ করছে আর তথাপি যদি সে সুন্নাহ অনুসরণ করতে অস্বীকার করে, তাহলে সে কেবল কুর’আন অনুসরণ করার তার দাবী সেই মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে।
৩) ইসলামী আইনের উৎস হিসেবে এবং দলীল হিসেবে সুন্নাহর মর্যাদা কুর’আনের সমপর্যায়ের এবং তা কুর’আনের সাথে হাতে হাত রেখে চলে।
৪) সুন্নাহর স্মরণাপন্ন হওয়া ছাড়া খোদ কুর’আনকেই সঠিকভাবে বোঝার উপায় নেই।
৫) উপরে বর্ণিত এ সকল পয়েন্টগুলোই নবী (সা.) এঁর সময় থেকেই প্রতিষ্ঠিত এবং এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে স্কলাররা কোন ব্যতিক্রম ছড়াই একমত।
সুন্নাহর কর্তৃত্ব ও মর্যাদার ব্যাপারে পরিস্কার সাক্ষ্য-প্রমাণ, সুন্নাহকে সেই সমস্ত বিষয়গুলোর মর্যাদা দান করে যেগুলো প্রশ্নাতীতভাবে দ্বীন ইসলামের একটা অংশ গঠন করে এবং যেগুলো সম্পর্কে প্রত্যেকের জ্ঞান থাকাটা অপরিহার্য। অপর কথায় বলতে গেলে স্কলারগণ এবং জনসাধারণ সবাই এই বিষয়গুলো সম্বন্ধে একই রকম সচেতন হওয়া উচিত। অবশ্য একটা আদর্শ ইসলামী পরিবেশে বড় হলে যে কারো দ্বীনের এই অত্যাবশ্যকীয় ব্যাপারগুলো না মেনে উপায় নেই। দ্বীনের এই অংশগুলোর যে কোনটি অস্বীকার করা হচ্ছে কুফর ও রিদ্দার সমতুল্য। ইবন তাইমিয়্যা বলেন,
পরিষ্কার ও নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত অবশ্যকরণীয় এবং পরিষ্কার ও নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠতি বর্জনীয় বিষয়গুলোতে বিশ্বাস স্থাপন হচ্ছে ঈমানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিগুলোর এবং দ্বীনের মূলনীতিগুলোর একটি। যে সেগুলো অস্বীকার করে সে [স্কলারদের ইজমামতে] একজন কাফির”

একইভাবে ইমাম নবভী বলেছেন, “আজ দ্বীন ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছে। মুসলমানদের ভিতর যাকাতের বাধ্যবাধকতার জ্ঞান এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, জনসাধারণ ও বিশেষজ্ঞগণ উভয় দলই সে সম্বন্ধে জানেন, বরং বলা যায় স্কলারগণ এবং অজ্ঞ ব্যক্তিগণ সকলেই এ ব্যাপারে সচেতন। কোনরূপ ব্যাখ্যার কারণে কেউ কেউ তা অস্বীকার করতে চাইলে তাকে ক্ষমা করা হয় না। মুসলিম সম্প্রদায় যেটার ব্যাপারে একমত, দ্বীনের এমন কোন দিক যদি কেউ অস্বীকার করে, তবে তার বেলায়ও একই বিধান প্রযোজ্য যদি সেই জ্ঞান ইতোমধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে থাকে। এরকম বিষয়গুলোর ভেতর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, রমাদান মাসের রোযা, সংসর্গ পরবর্তী গোসল, ব্যভিচারের নিষেধাজ্ঞা, মদের উপর নিষেধাজ্ঞা, নিকটাত্মীয়কে বিয়ের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা……. ইত্যাদি থাকবে। কিন্তু এটা যদি কেবল বিশেষজ্ঞদের ইজমার ব্যাপার হয়ে থাকে, যেমন একজন মেয়েলোক ও তার ফুফু বা খালার সাথে বিবাহিত হওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা, একজন খুনীর যে মীরাসের অধিকার নেই ( যে খুন হয়েছে তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে), এই বাস্তবতা যে একজন দাদী ১/৬ উত্তরাধিকার লাভ করে এবং এই ধরণের আরো বিষয়সমূহ – কেউ যদি এর একটিকে অস্বীকার করে তবে তাকে কাফির বলে গণ্য করা হয় না। বাস্তবে, ‘যতক্ষণ না তাকে ব্যাপারগুলো সম্বন্ধে জ্ঞানদান করা হচ্ছে ততক্ষণ’ তাকে মাফ করে দেয়া হয়। কেননা এই ধরণের বিষয়গুলোর জ্ঞান, জনসাধারণের ভিতর ছড়িয়ে দেওয়া হয় নি।”
অন্যান্য অনেক স্কলারদের থেকে এই ধরণের উদ্ধৃতি দেওয়া যাবে।
স্কলারদের সিদ্ধান্ত অনেকটা এই রকম যে, যা কিছু শক্তভাবে ও প্রশ্নাতীতভাবে দ্বীন ইসলামের অংশ হিসবে প্রতিষ্ঠিত, তা যে অস্বীকার করবে সে একজন কাফের এবং এই সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত। বাস্তবে যখন কেউ এই ধরণের কিছু অস্বীকার করে – অর্থাৎ সুন্নাহর অবস্থান ও মর্যাদা অথবা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত এধরণের কিছু – তখন সে আসলে খোদ কুর’আন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ব্যাপারে নাযিলকৃত কুর’আনের সকল আয়াতসমূহ অস্বীকার করা ছাড়া আর কিছুই করছে না। কুর’আনকে অস্বীকার করা এবং মিথ্যা মনে করা স্পস্টতই কুফর ও রিদ্দা। দুর্ভাগ্যবশত যে সব মুসলিমের পশ্চিমা ইহুদী ও খৃস্টান অতীত রয়েছে, তারা এ বিষয়ে ঢিলেঢালা হতে পারেন।

উদাহরণস্বরূপ এ ব্যাপারটা দুর্লভ নয় যে একজন খৃস্টান বাইবেল অথবা খৃস্টান মতবাদের যতটুকু ইচ্ছা ততটুকু প্রত্যাখান করবে এবং তা সত্ত্বেও একই সময়ে সে নিজেকে একজন পরিপূর্ণ ও সৎকর্মশীল খৃস্টান মনে করবে। ইসলামের বেলায় এই মনোভাব গ্রহণযোগ্য নয়। একবার কেউ ইসলাম গ্রহণ করে তখন তাকে অবশ্যই গোটা কুর’আন ও সুন্নাহকে নিরঙ্কুশ সত্য বলে গ্রহণ করতে হবে, সন্দেহাতীত ভাবে।
এ ছাড়া নিশ্চিতভাবে যা কিছু দ্বীন ইসলামের একটা অংশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত, তার যে কোন কিছুতে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে অবিশ্বাস বা কুফরের সমতুল্য। এই সিদ্ধান্ত কুর’আনের আয়াত সমূহ থেকে প্রমাণ করা যায়। যে কারো উচিত সুনির্দিষ্টভাবে কুর’আনের নিম্নলিখিত আয়াতগুলো খেয়াল করা:

তাহলে কি তোমরা কিতাবখানির একটি অংশ বিশ্বাস কর এবং বাকীটুকু অস্বীকার কর?সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এরকম করে তাদের একমাত্র প্রতিফলন পার্থিব জীবন হীনতা। এবং কিয়ামতের দিন তারা কঠিনতম শাস্তির দিকে নিপ্তি হবে। তারা যা করে আল্লাহ সে সম্মন্ধে অনবহিত নন।” (সূরা বাকারা, ২:৮৫)

যাদেরকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে তাদের বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন:
“সে সাদাকা দেয় নি এবং সালাত আদায় করেনি। বরং সে সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।” (সূরা ক্বিয়ামা, ৭৫:৩১-৩২)

আল্লাহ আরো বলেন:
“তার চেয়ে আর কে অধিকতর জুলুম করে যে আল্লাহ সম্মন্ধে মিথ্যা রচনা করে অথবা তার নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে? জালেমগণ কখনোই সফলকাম হয় না।” (আল আনআম, ৬:২১) 

অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
যারা আমার নিদর্শনকে অস্বীকার করে এবং সে সম্মন্ধে অহংকার করে তাদের জন্য আকাশের দ্বার উন্মুক্ত করা হবে না এবং তারা জান্নাতেও প্রবেশ করতে পারবে না – যতক্ষণ না সূঁচের ছিদ্রপথে উট প্রবেশ করে। অপরাধীদেরকে আমরা এভাবেই প্রতিফল দেব।” (আ’রাফ, ৭:৪০)

এরকম আরো বহু আয়াত যদিও আছে, সবশেষে আমরা আরো একটি আয়াত উল্লেখ করবো যেখানে আল্লাহ বলেন:
“….. কাফিরগণ ছাড়া কেউ আমাদের নিদর্শনাবলী অস্বীকার করে না।” (আনকুবুত, ২৯:৪৭)


যে ব্যক্তি সুন্নাহ প্রত্যাখ্যান করে তার ব্যাপারে বিভিন্ন স্কলারদের বক্তব্য

একজন মুসলিমকে একজন অমুসলিম থেকে পার্থক্যকারী বিষয়সমূহ নিয়ে ইসলামের যেসব স্কলার আলোচনা করেছেন, তারা এ ব্যাপারে একমত যে,
নবীর (সা.) সুন্নাহকে নিখুঁত উদাহরণ বলে মেনে নেয়ার বাধ্যবাধকতাকে যে অস্বীকার করে, সে মুরতাদ হয়ে যায়।

ইবন হাজম লেখেন
একজন ব্যক্তি যদি বলে, ‘আমরা কেবল কুর’আনে যা পাই তাই অনুসরণ করি’ তবে এই (মুসলিম) জাতির ইজমা মতে সে একজন কাফির হয়ে গেছে।”

আল-শাওকানী বলেন,
সুন্নাহর অবস্থান এবং আইনের এক স্বনির্ভর উৎস হিসাবে এর মর্যাদা হচ্ছে এমন এক জ্ঞানের অংশ যা প্রত্যেক মুসলিমেরই জানা রয়েছে। এবং ইসলামের সাথে যাদের সম্পর্ক নেই তারা ছাড়া আর কেউই এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে না।”


যে ব্যক্তি সুন্নাহ প্রত্যাখ্যান করে এবং কেবল কুর’আন অনুযায়ী জীবন যাপন করে, তার ব্যাপারে শায়খ আল দাওসিরিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি বলেন:
“…..এটা হচ্ছে যিন্দিক এবং উৎপথগামীদের দাবী, যারা কিনা ঈমানের অর্ধেক অস্বীকার করে এবং তারা কুর’আনকে সম্মান দেখাচ্ছে বলে মানুষকে বোকা বানায়। তারা হচ্ছে মিথ্যাবাদী কেননা কুর’আন নিশ্চয়ই রাসূলের (সা.) প্রতি আনুগত্যের আদেশ দেয় আর যা কিনা কেবল সুন্নাহ অনুসরণের মাধ্যমেই করা সম্ভব…..। এ ব্যাপারে আর কারো কাছ থেকেই কোন ভিন্নমত নেই, কেবল তারা ছাড়া যাদের সাথে দ্বীন ইসলামের কোন ধরণের কোন সম্পর্ক নেই।”

আবদুল আযীয বিন বায লিখেছেন:
সুন্নাহ অস্বীকার করা এবং সেটাকে প্রযোজ্য নয় বলে মনে করা হচ্ছে কুফর ও রিদ্দার একটা কাজ, কেননা যে কেউ যে সুন্নাহ অস্বীকার করে সে আসলে কুর’আনই অস্বীকার করে। আর যে কেউ যে (কুর’আন ও সুন্নাহর) যে কোন একটি অথবা দুটোই অস্বীকার করে সে আসলে সকলমাযহাবের মত অনুযায়ী কাফির।”

আস-সূয়ুতী বলেন:
নবী (সা.)-এঁর হাদীস যা তাঁর কোন একটি কথা বা কাজের বর্ণনা (এবং যা কিছু সহীহ হবার শর্তগুলা পূরণ করে) সেটাকে দলীল বলে গ্রহণ করতে যে অস্বীকার করে, তোমাদের জানা উচিত, এবং আল্লাহ তোমাদের সকলের উপর রহম করুন, যে সে একজন কাফির হয়ে গেছে। এবং (কিয়ামতের দিন) তাকে ইহুদী ও খৃষ্টানদের সাথে, অথবা আল্লাহ তাকে অন্য যে দলের সাথে ইচ্ছা করেন, সে দলের সাথে একত্রিত করবেন।”

এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে – যে সুন্নাহ অস্বীকার করে, তার অবিশ্বাস বা কুফর যে কেবল কিছু মানুষ বা স্কলারদের অনুসিদ্ধান্ত, আর তাই সেটা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে, ব্যাপারটা কিন্তু সেরকম নয়, অথবা ব্যাপারটা কিন্তু এমনও নয় যে, তা কেবলই স্কলারদের ইজমা, যা হলে অবশ্য সেটার বিরোধিতা করা আরো কঠিন হতো। বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, এমন বেশ কতগুলো আয়াত যেগুলো আমরা ইতোমধ্যেই উপস্থাপন করেছি, তা থেকে পরিস্কারভাবে বোঝা যায় যে, যে সুন্নাহকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে (বা সুন্নাহর কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে) তার অন্তর ঈমানশূন্য এবং সে অবিশ্বাসীদের একজন। বিশেষভাবে যে কারো উচিত পূর্বে আলোচিত নিম্নলিখিত আয়াতগুলো খেয়াল করে দেখা:
কিন্তু না, তোমার রবের শপথ, তারা ততক্ষণ পর্যন্ত সত্যিকার বিশ্বাস করে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের বিচার-ফয়সালার ভার তোমার উপর ন্যস্ত করে না, এবং তুমি যা ফয়সালা দাও সে ব্যাপারে মনে কোন অসন্তোষ বোধ করে না এবং পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে” (সূরা নিসা, ৪:৬৫)


“যখন তাদেরকে বলা হয় ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার কাছে আস এবং রাসূলের কাছে আস’ তুমি তখন মুনাফিকদের বিরক্তিভাবে তোমার দিক থেকে পিঠ ফিরিয়ে নিতে দেখ” (সূরা নিসা, ৪:৬১)

“বলুন, আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর। আর তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তবে জেনে রাখ যে আল্লাহ কাফিরদের ভালবাসেন না।” (আলে ইমরান, ৩:৩২)

বাস্তবে গোটা সুন্নাহকে অস্বীকার করার মাঝেই এই কুফর বা অবিশ্বাস সীমাবদ্ধ নয়, বরং রাসূল (সা.)-এঁর বরাত দিয়ে, যে কেউ যা কিছু শোনে, সে যদি নিশ্চিত হয় যে সত্যিই তা রাসূল(সা.)-এঁর কাছ থেকে এসেছে, তবে সেটা অস্বীকার করার নামই কুফর।

সুলায়মান ইবন সাহমান বলেন,
স্কলারদের ভিতর এ ব্যাপারে কোন মতপার্থক্য নেই যে, কোন ব্যক্তি যদি কিছু কিছু বিষয়ে নবীকে (সা.) বিশ্বাস করে এবং কোন বিষয়ে নবীকে (সা.) অস্বীকার করে, তবে সে ইসলামেপ্রবেশ করে না; সে হচ্ছে তার মত যে কোন ফরজ কাজ অস্বীকার করে…..।”

ইবন বাত্তাহ বলেন,
রাসূল (সা.) যা নিয়ে এসেছেন, কোন ব্যক্তি যদি তার একটি ছাড়া সবকিছুতেই বিশ্বাস করে এবং সেই একটিকে প্রত্যাখ্যান করে, তবে সে সকল স্কলারের মতানুযায়ী একজন কাফের।”

উপরন্তু নবীর (সা.) কোন বক্তব্য সে বিশ্বাস করতে চায়, আর কোন বক্তব্য সে বিশ্বাস করতে চায় না এ ব্যাপারে নিজস্ব খেয়াল খুশির স্বাধীনতা তার নাই। নবীর (সা.) উপর যে কারো বিশ্বাস এই দাবী রাখে যে, সে নবীর (সা.) বলা সবকিছুকে বিশ্বাস করবে। 


আমরা যা আলোচনা করছি তা যেন কেউ ভুল না বোঝে এবং তার যেন অপপ্রয়োগ না হয় সেজন্য তিনটি বিষয় উল্লেখ করার রয়েছে:
প্রথমত, একটা হাদীস সহীহ কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা এবং একটা হাদীসকে সহীহ জেনেও তার বক্তব্যের সত্যতাকে অস্বীকার করার ভিতর তফাত রয়েছে। উপরে বর্ণিত দ্বিতীয় ব্যাপারটা হচ্ছে অনেকটা এরকম যে কেউ বলছে, “আমি জানি নবী (সা.) বলেছেন, কিন্তু আমি তা বিশ্বাসযোগ্য মনে করি না [অর্থাৎ আমি তা ঠিক মনে করি না]।” এটাই হচ্ছে সালমান ও ইবন বাত্তাহর মত স্কলাররা সেটাকে অবিশ্বাস বলে বর্ণনা করেছেন। পূর্ববর্তী উদাহরণ যেখানে কেউ একটা হাদীস সহীহ কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে, সেটা একটা অবিশ্বাস বা কুফরের কাজ নাও হতে পারে – অবশ্য তা নির্ভর করবে ঐ নির্দিষ্ট হাদীসটি কতটুকু প্রতিষ্ঠিত ও সর্বজনবিদিত তার উপর। সে যাই হোক, হাদীস সহীহ কিনা সেটা বাছবিচার করা হচ্ছে হাদীস বিশেষজ্ঞদের কাজ। আলেম বা বিশেষজ্ঞ নন এমন একজন মানুষের নিজের থেকে হাদীসের বাছ-বিচার করার স্বাধীনতা নেই।

দ্বিতীয়ত, কুর’আনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও, সুন্নাহ সম্মন্ধে কারো অজ্ঞতা ক্ষমা করা যেতে পারে; যেমনটা একজন নতুন ধর্মান্তরিত ব্যক্তির বেলায় ঘটতে পারে। যে কুর’আনের দলীল প্রমাণের সংস্পর্শে আসেনি অথবা সে কেবল ঐ ধরণের লোকের সংস্পর্শে এসেছে যারা সুন্নাহ অস্বীকার করে। একবার যখন তাকে প্রমাণ দেখানো হবে, তখন তার সে সব বিশ্বাস করা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। সবশেষে, কাউকে কাফির ঘোষণা করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ব্যাপারটিকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। যে কাউকে কাফির ঘোষণা করার আগে এমন বহু শর্ত আছে যেগুলিকে পূরণ করতে হবে।

এখানে আর একটি বিষয় ভুললে চলবে না যে, তওবার দরজা সবসময় খোলা রয়েছে। যে কেউ যখন বিশ্বস্ততার সাথে ও অনুশোচনার সাথে তওবা করে, আল্লাহর দিকে ফিরে আসে, আল্লাহ সেটা খুবই পছন্দ করেন। কেউ সুন্নাহ অস্বীকার করার পর্যায়ে অথবা নবীর কোন একটি সুনির্দিষ্ট হাদীস অস্বীকারের পর্যায়ে কেন পতিত হতে পারে, তার বহুবিধ কারণ সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহই অবগত – বিশেষত আজকের এই দিনক্ষণে যখন সুন্নাহর উপর অবিশ্বাসীদের পক্ষ থেকে যেমন আক্রমন আসছে, তেমনি দুঃখজনকভাবে খোদ মুসলমানদের পক্ষ থেকেই আক্রমন করা হচ্ছে। ব্যাপারটা এরকমও হতে পারে যে, একজন মুসলিমের ”সুন্নাহর অবস্থান ও মর্যাদা” সম্পর্কে পড়ার সৌভাগ্যই কখনো হয়নি। ব্যাপারটা এরকমও হতে পারে যে, যারা সুন্নাহ অনুসরণ করতে অস্বীকার করে, অথবা, যারা ইসলামে এর মর্যাদা ও কর্তৃত্ব অস্বীকার করে – একজন মুসলিম কেবল তাদের দ্বারাই পরিবেষ্টিত থেকেছে। বাস্তবে ব্যাপারটা যাই হোক না কেন আল্লাহর কাছে তওবা করা এবং সুন্নাহর সাথে লেগে থাকার সংকল্প এবং বিশ্বস্ত নিয়ত, যে কারো অতীতের সমস্ত গুনাহ মুছে দিতে পারে। এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার ও জান্নাতে প্রবেশ করার সৌভাগ্য এনে দিতে পারে।

উপসংহার

ইসলামে সুন্নাহর অবস্থানকে অস্বীকার করা, এটা অস্বীকার করা যে, নবী (সা.) যা বলেছেন তা বিশ্বাস করাটা আমাদের জন্য ফরজ, এটা অস্বীকার করা যে তাঁর আদেশ ও নিষেধ আমাদের জন্য শিরোধার্য অথবা এটা অস্বীকার করা যে, তিনিই হচ্ছেন সেই উদাহরণ যা প্রতিটি মুসলিমকে অনুসরণ করতে হবে – এ সবই হচেছ কুফর বা অবিশ্বাসের কাজ। পরিস্কার প্রমাণ দেখানোর পরে বা ব্যাখ্যা করার পরেও যদি কোন ব্যক্তি ইচ্ছা করে বা জেনেশুনে ঐ ধরণের বিশ্বাস [সুন্নাহর মর্যাদা অস্বীকার করার মত বিশ্বাস] ধারণ করা অব্যাহত রাখে, তবে সে ইসলামের গন্ডীর বাইরে চলে যায় বরং সে একজন কাফের। এই পৃথিবীতে তাকে একজন অবিশ্বাসী বা কাফির বলে গণ্য করতে হবে। একজন মু’মিন ভাইয়ের প্রতি যে কারো যে ভালবাসা ও সম্মান দেখানোর কথা, সে সেটা পাবার যোগ্য নয়। মৃত্যুর পূর্বে সে যদি তওবা না করে, তবে তার সকল সৎকর্ম তার কোন কাজে আসবে না এবং আখিরাতে সে চিরতরে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে।
এর অর্থ এই নয় যে, আমরা তাড়াতাড়ি করে অন্যদের কাফের বলে সম্মোধন করবো। যে কাউকে এ ধরণের ব্যাপারে সবসময়ে সতর্ক থাকা উচিত এবং নিশ্চিত করা উচিত যে, যারা দ্বীনবিরোধী বিশ্বাস পোষণ করে তাদের কাছে পরিস্কার দলিল উপসথাপন করা হয়েছে। (বাস্তবে সবচেয়ে ভাল হচ্ছে এ ধরণের ব্যাপারগুলো দ্বীনের ব্যাপারে যাদের গভীর জ্ঞান রয়েছে, সেই ধরণের স্কলারদের হাতে ছেড়ে দেয়া) তবে কুর’আন ও সুন্নাহর দলিলসমূহ স্পষ্ট। সেগুলো অবশ্যই মেনে চলতে হবে এবং সেগুলো অবশ্যই প্রকাশ্যে বলতে হবে। এ ধরণের ব্যাপারে আবেগের কোন স্থান নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না কুর’আন এবং সুন্নাহর দলীল থেকে পরিস্কার ও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাবে যে, ঐরকম একজন ব্যক্তিকে কাফের বলে গণ্য করতে হবে এবং এই রায়ের পথে কোন অন্তরায় নেই, ততক্ষণ পর্যন্ত আরেকজন ব্যক্তিকে কাফের ঘোষণা করার অধিকার কারো নেই। একইভাবে কারো উচিত নয় অপর কোন ব্যক্তিকে মুসলিম বলে গণ্য করা, যতক্ষণ কুর’আন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে তা প্রমাণিত হয় না যে ঐরকম একজন ব্যক্তি মুসলিম। পরিস্কার এবং সুনির্দিষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করার পরও যদি কোন ব্যক্তি সুন্নাহ বিশ্বাস করার ও তা অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতাকে অস্বীকার করে, তবে সে একজন মুসলিম হিসাবে গণ্য হবার অথবা সুবিধা পাবার অধিকার হারাবে এটাই হচ্ছে কুর’আন, সুন্নাহ ও স্কলারদের ইজমার ঘোষণা।