মহান আল্লাহ তায়া’লা ইরশাদ করেন

الذين يقيمون الصلوة ومما رزقنهم ينفقون- اولئك هم المومنون حقا- لهم درجت عند ربهم ومغفرة ورزق كريم-

‘‘যারা নামায কায়েম করে এবং আমার দেয়া রিযিক থেকে ব্যয় করে। তারা হল সত্যিকার ঈমানদার। তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মান জনক রিযিক। [ সূরা আনফাল-৩-৪]

Pages

হযরত (স:) বিদায় হজ্জ এবং ওফাত

বিদায় হজ্জ এবং ওফাত


হজ্জের জন্য রওয়ানা

দশম হিজরীতে হযরত (স) আবার হজ্জের ইরাদা করলেন। ঐ বছর জিলকদ মাসে তাঁর হজ্জে গমনের কথা ঘোষণা করে দেয়া হলো। এ সংবাদ তামাম আরব ভূমিতে ছড়িয়ে পড়লো। হযরত (স)-এর সঙ্গে হজ্জ করার সৌভাগ্য অর্জনের নিমিত্ত সমগ্র আরববাসীর মধ্যে প্রবল আগ্রহ জাগলো। জিলকদের শেষ দিকে হযরত (স) মদীন থেকে যাত্রা করলেন এবং জিলহজ্জের চার তারিখে তিনি মক্কায় উপনীত হলেন। মক্কায় পদার্পণের পর প্রথমেই তিনি কা’বা শরীফ তওয়াফ করলেন। অতঃপর মাকামে ইবরাহীমে দু’রাকাত নামায পড়লেন। তারপর পর্যায়ক্রমে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে আরোহণ করলেন এবং সেখান থেকে কাজ সেরে আট তারিখ বৃহস্পতিবার সমস্ত সহযাত্রীকে নিয়ে মিনায় অবস্থান করলেন। পরদিন নয় জিলহজ্জ সকালে ফজরের পর তিনি মিনা থেকে আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলেন। এখানে হযরত (স) তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন, যাতে ইসলামে পূর্ণ দীপ্তি ও ঔজ্জ্বল্যের প্রকাশ ঘটেছে। এই ভাষণে তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্দেশ প্রদান করেন। নিম্নে এর কতিপয় অংশ উদ্ধৃত করা যাচ্ছেঃ

হজ্জের ভাষণ

‘জনমণ্ডলী! শুনে রাখো, জাহিলী যুগের সমস্ত প্রথা ও বিধান আমার দু পায়ের নীচে ।’
‘অনারবদের ওপর আরবদের এবং আরবদের ওপর অনারবদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তেমনি সাদার ওপর কালোর কিংবা কালোর ওপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তোমরা সবাই আদমের সন্তান আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মৃত্তিকা থেকে। মর্যাদার ভিত্তি হচ্ছে শুধু তাকওয়া।’
‘মুসলমানরা পরস্পর ভাই ভাই। সাবধান! আমার পরে তোমরা একজন আরেক জনকে হত্যা করার মতো কুফরী কাজে লিপ্ত হয়ো না।’
‘তোমাদের গোলাম! তোমাদের ভৃত্য! তোমরা নিজেরা যা খাবে, তা-ই তাদের খাওয়াবে; নিজেরা যা পরবে, তা-ই তাদের পরতে দিবে।’
‘জাহিলী যুগের সমস্ত রক্তের বদলা বাতিল করে দেয়া হলো। (এখন আর কেউ কারো কাছ থেকে পুরানো রক্তের বদলা নিতে পারবে না। সর্বপ্রথম আমি নিজ খান্দানের রক্ত -রাবি‘আ বিন্‌ হারিসের পুত্রের রক্ত বাতিল করে দিলাম।’
‘জাহিলী যুগের সমস্ত সূদও বাতিল করে দেয়া হলো। (এখন আর কেউ কারো কাছে সূদ দাবি করতে পারবে না) সর্বপ্রথম আমি নিজ খান্দানের সূদ-আব্বাস বিন আবদুল মুত্তালিবের সূদ - বাতিল করে দিলাম।৫৬
‘মেয়েদের ব্যাপারে খোদাকে ভয় করো। জেনে রাখ, তাদের ওপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে, তেমনি রয়েছে তোমাদের ওপর তাদের অধিকার । তাদের কল্যাণের বিষয়ে আমার নসিহত গ্রহণ করো।’
‘আজকের এই দিন, এই মাস এই এই শহরটি যেমন সম্মানার্হ, তেমনি তোমাদের রক্ত, তোমাদের ইজ্জত, তোমাদের ধন-দৌলত পরস্পরের প্রতি কিয়ামত পর্যন্ত সম্মানার্হ।
‘আমি তোমাদের মধ্যে একটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, তোমরা যদি তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো, তাহলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না আর তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব।’
এরপর তিনি শরীয়তের অনেক মৌলিক বিধান বিবৃত করেন। অতঃপর জনতার কাছে জিজ্ঞেস করেন :
‘খোদার দরবারে আমার সম্পর্কে তোমাদের কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, তোমরা কি বলবেঃ’
সাহাবীগণল বলেন, ‘আমরা বলবো, আপনি আমাদের কাছে পয়গাম পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং আপন কর্তব্য পালন করেছেন।’ তিনি আসমানের দিকে শাহাদাত অঙ্গুলি তুলে তিনবার বললেন : ‘হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থেকো।’
এ সময় কুরআনে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হলোঃ
‘আজকে আমি দ্বীন (ইসলাম)-কে তোমাদের জন্যে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করে দিলাম আর দ্বীন (জীবন পদ্ধতি) হিসবে ইসলামকে তোমাদের জন্যে মনোনীত করলাম।
এই হজ্জ উপলক্ষে হযরত (স) হজ্জ সংক্রান্ত তাবত নিয়ম-নীতি নিজে পালন করে দেখান। এ প্রসঙ্গে তিনি বললেন : ‘আমার কাছ থেকে হজ্জের নিয়ম-কানুন শিখে নাও। হয়তো বা এরপর আমার দ্বিতীয় বার হজ্জ করার সুযোগ হবে না।’
এরপর তিনি সমস্ত মুসলমানকে লক্ষ্য করে বলেন : ‘উপস্থিত ব্যক্তিগণ (এসব কথা)) অনুপস্থিত লোকদের কাছে পৌঁছে দিও।’

অসুস্থতা

এগার হিজরীর সফর মাসের ১৮ কি ১৯ তারিখে হযরত (স)-এর শরীরে অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ পেডলো। সে দিন ছিলো বুধবার। পরবর্তী সোমবার দিন অসুস্থ‌তা অত্যন্ত তীব্র হয়ে উঠলো। যতোক্ষণ শক্তি ছিলে, ততোক্ষণ তিনি মসজিদে গিয়ে নামায পড়ালেন। তিনি সর্বশেষ যে নামায পড়ান, তা ছিলো মাগরিবের নামায। মাথায় তাঁর বেদনা ছিলো। তিনি রুমাল বেঁধে মসজিদে এলেন এবং নামাযে সূরা মুরসালাত পাঠ করলেন। এশার সময় তিনি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়লেন। তাই মসজিদে আসতে না পেরে আবু বকর সিদ্দিক (রা)-কে নামায পড়াতে বললেন। এপর কয়েকদিন যাবত আবু বকর সিদ্দীক (রা) নামায পড়ালেন।

শেষ ভাষণ এবং নির্দেশাবলী

মাঝখানে একদিন তিনি একটু ভালো বোধ করেন। তিনি গোসল করে মসজিদে এলেন এবং ভাষণ প্রদান করলেন। এটি ছিলো তাঁর জীবনের শেষ ভাষণ। তিনি বললেন :
‘খোদা তাঁর এক বান্দাকে দুনিয়ার নিয়ামত কবুল করার কিংবা খোদার কাছে (আখিরাতের) যা কিছু আচে, তা গ্রহণ করার ইখতিয়ার দিয়েছেন। কিন্তু বান্দাহ আল্লাহ নিকটের জিনিসই কবুল করে নিয়েছে।’
একথা শুনে হযরত আবু বকর (সা) এর ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে কেঁদে উঠলেন। হযরত (স) এরা বললেনঃ
‘আমি সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ আবু বকরের দৌলত ও তাঁর বন্ধুত্বের কাছে । যদি দুনিয়ায় আমার উম্মতের ভেতর থেকে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে পারতাম তো আবু বকরকেই গ্রহণ করতাম। কিন্তু বন্ধুত্বের জন্যে ইসলামের বন্ধনই যথেষ্ট।’
‘আরো শোন, তোমাদের আগেকার জাতিসমূহ তাদের পয়গাম্বর ও সম্মানিত লোকদের কবরকেই ইবাদতগাহ বানিয়ে নিয়েছে। দেখো, তোমরা এরূপ করে না। আমি তোমাদের নিষেধ করে যাচ্ছি।’
পুনরায় বললেন : ‘হালাল ও হারামকে আমার প্রতি আরোপ করা যাবে না; কারণ খোদা যা হালাল করেছেন, তা-ই আমি হালাল করেছি আর তিনি যা হারাম করেছেন, তা-ই আমি হারাম করেছি।
এই অসুস্থ অবস্থায় একদিন তিনি আপন খান্দানের লোকদের উদ্দেশ্যে বলেনঃ ‘হে পয়গাম্বরের কন্যা ফাতিমা এবং হে পয়গাম্বরের ফুফু সাফিয়া! খোদার দরবারে কাজে লাগবে, এমন কিছু করে নাও। আমি তোমাদেরকে খোদার হাত থেকে বাঁচাতে পারি না।’
একদিন রোগ-যন্ত্রণা খুব বেড়ে গেলো। তিনি কখনো মুখের ওপর চাদর টেনে দিচ্ছিলেন আবার কখনো তা সরিয়ে ফেলছিলেন। এমনি অবস্থায় হযরত আয়েশা (রা) তাঁর মুখ থেকে শুনতে পেলেন : ‘ইহুদী ও নাসারাদের প্রতি খোদার লা’নত! তারা আপন পয়গাম্বরদের কবরকে ইবাদতগাহ বানিয়ে নিয়েছে।’
একবার তিনি হযরত আয়েশা (রা)-এর কাছে কিছু আশরাফী জমা রেখেছিলেন। এই অস্থিরতার ভিতরেই তিনি বললেন : ‘আয়েশা! সেই আশরাফীগুলো কোথায়! মুহাম্মদ কি খোদার সঙ্গে খারাপ ধারণা নিয়ে মিলিত হবে! যাও, ঐগুলোকে খোদার পথে দান করে দাও।’
রোগ-যন্ত্রণা কখনো বাড়ছিলো, কখনো হ্রাস পাচ্ছিলো। ওফাতের দিন সোমবার দৃশ্যত তাঁর শরীর অনেকটা সুস্থ ছিলো। কিন্তু দিন যতো গড়াতে লাগলো, ততোই তিনি ঘন ঘন বেঁহুশ হতে লাগলেন। এই অবস্থায় প্রায়শ তাঁর মুখে উচ্চারিত হলো (আল্লাহ যাদের অনুগৃহীত করেছেন, তাদের সঙ্গে) কখনো বলতেন ‘হে খোদা! তুমি মহান বন্ধু’।
এই সব বলতে বলতে তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটতে লাগলো। এক সময় তাঁর রূহে পাক আলমে কুদসে গিয়ে পৌঁছলো।
মৃত্যুর সাল এগারো হিজরী। মাসটি ছিলো রবিউল আউয়াল এবং দিনটি সোমবার। সাধারণভাবে প্রচলিত যে, তারিখটি ছিলো ১২ রবিউল আউয়াল। কিন্তু এ ব্যাপারে মতানৈক্য আছে। ‘সীরাতুন্নবী’ প্রণেতা মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদবীর মতে তারিখটি ছিলো ১ রবিউল আউয়াল।
পরদিন জানাযা ইত্যাদি সমাধা করা হলো এবং সন্ধা নাগাদ যে ঘরে তিনি ইন্তেকাল করেন, সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হলো।